ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

২৫ বছরে পিকেএসএফ: উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা

ড. জসীম উদ্দিন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৪
২৫ বছরে পিকেএসএফ: উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা

কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউণ্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রতিষ্ঠা করে। কোম্পানি আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত পিকেএসএফ একটি `লাভের জন্য নয়’ প্রতিষ্ঠান, যার অর্থ প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ের অতিরিক্ত আয় কোন ব্যক্তি বিশেষের মাধ্যমে বণ্টিত না হয়ে পুনরায় দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যে কোন কাজে ব্যয়িত হবে।

পিকেএসএফ মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম সরাসরি বাস্তবায়ন না করে এর সহযোগীসংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে।

পিকেএসএফ জুন ২০১৪ পর্যন্ত ২৭৩টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে গ্রাম ও শহর এলাকার প্রায় ১.০৬ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১.৭৪ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। এই বিতরণকৃত ঋণের আদায় হার ফাউণ্ডেশন ও সহযোগীসংস্থা পর্যায়ে শতকরা ৯৮.৮৫ ভাগ এবং সহযোগীসংস্থা ও সদস্য পর্যায়ে শতকরা ৯৯.৬৫ ভাগ।

মাঠ পর্যায়ে উচ্চ আদায় হার রক্ষার্থে পিকেএসএফ সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনিক ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে চাহিদা মাফিক অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। সহযোগী সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৬৪ হাজার কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীকে সুশাসন, হিসাব,  তথ্য ও ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনা, আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের উপর বিবিধ প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

এছাড়াও প্রায় ২৯ লক্ষ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন আয়বৃদ্ধিমূলক, শস্য, অশস্য, পশুসম্পদ, সামাজিক ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কম্পিউটার, মোটর সাইকেল, বাইসাইকেল ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য এ পর্যন্ত পিকেএসএফ ৩০ কোটি টাকার নমনীয় ঋণ সহায়তা দিয়েছে। পিকেএসএফ এর ‘কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ’ মডেল ইতোমধ্যে দেশ ও বিদেশে অনুকরণীয় ও  প্রশংসিত হয়েছে।

দেশের স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ ও সাধারণ পর্ষদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দিক নির্দেশনায় পিকেএসএফ পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ফাউণ্ডেশনের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তণ মুখ্য সচিব মোঃ আবদুল করিম। এছাড়া পিকেএসএফ-এর রয়েছে উচ্চ মান সম্পন্ন দক্ষ কর্মীবাহিনী যারা দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে এবং পিকেএসএফ-এর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নিরলসভাবে শ্রম ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

পিকেএসএফ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তার কার্যক্রম উত্তোরোত্তর সম্প্রসারণ করছে এবং স্বাভাবিকভাবেই  তার কার্যক্রম, কর্মসূচি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীসংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তায় অনেক প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বর্তমানেও  এর মূল কার্যক্রম ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইফাদ, ডিএফআইডি প্রভৃতি উন্নয়ন সহযোগীর আর্থিক সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্প  বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

পিকেএসএফ তার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মোট ব্যয়ের সিংহভাগ ব্যয় করে থাকে দেশের দরিদ্র মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে। এ প্রাতিষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পিকেএসএফ সরকার ও বিভিন্ন বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প ও কর্মসূচি হলো দেশে মঙ্গা নিরসনের জন্য বৃহত্তর বরিশাল ও রংপুর জেলায় মংগা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ (সংযোগ), দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে দরিদ্র পরিবারগুলোর সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি (সমৃদ্ধি) কর্মসূচি, বৈশ্বিক জলবায়ু উষ্ণতাজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য কমিউনিটি ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রকল্প, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বীমা সেবা প্রদান এবং অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়নের লক্ষে গৃহীত ইউপিপি-উজ্জীবিত প্রকল্প।

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয়ের আওতায় প্রকল্প এলাকায় দরিদ্র মানুষের বসত-ভিটা উঁচুকরণ, প্রতিটি বেসরকারি স্কুল/কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, পাঠাগার প্রভৃতি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য টিউবওয়েল ও  ল্যাট্রিন স্থাপন বা মেরামত, শিক্ষা কার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, যুব কর্মসংস্থান, বিশেষ সঞ্চয়, আর্থিক সহায়তা, দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের মেধা বৃত্তি প্রভৃতি কাজে সহায়তা করা হচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে পিকেএসএফ প্রাতিষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় করেছে প্রায় ৬১.২৭ কোটি টাকা, যা ২০১১-১২ ও ২০১০-১১ অর্থ বছরে ছিল যথাক্রমে ৩৪.৩৪ ও ৩০.৬৭ কোটি টাকা। মূলত দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে দরিদ্র মানুষদের অধিকতর সেবা দিতেই পিকেএসএফ-এর এ ব্যয় প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া পিকেএসএফ-এর উন্নয়ন সহযোগীরাও এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অর্থায়ন অব্যাহত রেখেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ব্যয়িত অর্থ উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট হতে পুণঃভরণ হিসেবে পাওয়া যায়।

কর্মসূচি/প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য ব্যয়-এর দ্বিতীয় খাতটি হলো ঋণক্ষয় সঞ্চিতির সংস্থান রাখা। এ খাতটি যে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ের খাত, যা একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় সংগঠিত হয়ে থাকে। পিকেএসএফ এক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করে। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে প্রতিবছর কিছু অর্থ ঋণ ক্ষয় সঞ্চিতি তহবিলে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে যা প্রতি বছর আয়-ব্যয় নির্ণয়ে খরচ হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৮৮.৯০ কোটি টাকা ঋণ ক্ষয় সঞ্চিতি খরচ হিসেবে সংস্থান রাখে যা মূলত হয়েছে ওই বছর কয়েকটি বড় সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ে কিছু অর্থ ফেরৎ দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। ঋণক্ষয় সঞ্চিতি বাবদ সংস্থানকৃত এ অর্থ পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তবে ওই সংস্থাগুলো ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের শুরুতে বকেয়া অর্থসহ বর্তমান প্রাপ্য অর্থের অংশ নিয়মিত পরিশোধ করায় ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে কোন ঋণ ক্ষয় সঞ্চিতির প্রয়োজন হবেনা বরং ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ৮৯.২৫ কোটি টাকা আয় হিসেবে গণ্য হবে, যা প্রতিষ্ঠানটি নীট উদ্বৃত্ত বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। প্রকৃত পক্ষে ঋণক্ষয় সঞ্চিতি প্রতিষ্ঠানটির কোন লোকসান নয়, এটি একটি সাময়িক সঞ্চিতি। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ৮৮.৯০ কোটি টাকা ঋণক্ষয় সঞ্চিতি প্রভিশন করার কারণে ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির মোট আয়ের সাথে মোট ব্যয়ের অনুপাত কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এর পূর্ব ও পরবর্তী বছরগুলোতে মোট আয়ের সাথে মোট ব্যয়ের অনুপাত কম রয়েছে।

ড. জসীম উদ্দিন: ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, পিকেএসএফ

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।