ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা

আকাশ চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা মো. মকবুল হোসেন ভূঁইয়া

তিনি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। একাত্তরের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য নিজ বাড়ি থেকে রওনা হন।

খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনেছেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ ভাষণ শোনার পর থেকেই ভাবতে শুরু করলেন দেশ ও জাতির জন্য কিছু একটা করতে হবে। কয়েক দিন পর ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করলো ঢাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে। শুরু হলো হত্যা ও নির্যাতন। তিনি ভাবলেন, আর বসে থাকার সময় নেই। দেশ ও জাতিকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে হলে যুদ্ধে যেতেই হবে। যেই কথা সেই কাজ। ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর মোকাবিলা করতে। বিজয় ছিনিয়ে আনলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। আর সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মকবুল হোসেন ভূঁইয়া।

নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার উদয়দি গ্রামের মরহুম আমজাদ আলী ভূঁইয়ার পুত্র মো. মকবুল হোসেন ভূঁইয়া বাড়ির কাউকে কিছু না বলে ভাতিজা রেজাউল করিম ও ভাগনে নূরুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে ৩০ এপ্রিল বিকেলে পায়ে হেঁটে যুদ্ধের উদ্দেশে রওয়ানা হন। কুমিল্লার কসবা সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করেন পরদিন সন্ধ্যায়। আগরতলা কংগ্রেস ভবনে রাত্রী যাপনের পর তাদের জয়নগর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বাঘমারা, পরে চারপাড়া হাইস্কুল ক্যাম্পে যান। সেখানে এক মাস অবস্থান করার পর তাদেরকে গেরিলা হিসেবে রিক্রুট করে ভারতের সেনাবাহিনীর ট্রাকে তুলে পাহাড়ে জঙ্গলের ভেতর উম্পিনগর গেরিলা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পঁয়ত্রিশ দিন প্রশিক্ষণ দেয়া হয় রাইফেল, স্টেনগান, বেটাগান, এসএলআর, এলএমজি, টু-ইঞ্চ মর্টার, জি থ্রি রাইফেল, থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, ডিনামাইট, এন্টি এয়ার ক্রাপ্ট, মলোটে ককটেল, স্মোক বোম, আন আর্মড কম্বাট, বেয়নেট ফাইটিং ইত্যাদির। এসব প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক ছিলেন মেজর শ্যাম বাহাদুর থাপা, ক্যাপ্টেন চৌহান সিং ও রাজেন্দ্র কিশোর, ইন্সপেক্টর কিশোর কুমার।

প্রশিক্ষণ শেষে তাদের আগরতলার দুই নম্বর সেক্টর মেলাঘর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এ সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ হোসেন ও সহ-অধিনায়ক মেজর হায়দার। আগস্ট মাসে মো. মকবুল হোসেন ভূঁইয়াসহ দশজন গেরিলাকে সঙ্গে নিয়ে মেজর হায়দার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে যুদ্ধে নামান। দুই আগস্ট মকবুল নিজ গ্রাম উদয়দি পৌঁছলে পিতৃহারা ছেলেকে দেখে মা আকলিমা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। মা’র সাথে একদিন থাকার পর মকবুল হোসেন দেশ মাতৃকার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় আড়াইহাজার থানা কমান্ডার ছিলেন আবদুস সামাদ। যুদ্ধ করেন আড়াই হাজার থানা, ভুলতা, গোলাকান্দাইল, আদমজী, পাচরুখী, মাধবদী, কাঁচপুর, বগাদি, বিশনন্দী এলাকায়।

এর মধ্যে স্মরণীয় একটি যুদ্ধ কাহিনী হলো ৩০ অক্টোবরের। আগেরদিন মোঃ মকবুল হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধাদের দল পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য রওয়ানা হন নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার গাউছিয়ায়। রাতের অন্ধকারে দীর্ঘ চার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ভোর চারটায় পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে তিনশ’ গজ দূরে অবস্থান নেন। একটি পুকুরের পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেলা ১১ টায় পাক সেনারা তাদের ক্যাম্পে যখন একত্রিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ কমান্ডার বজ্রকণ্ঠে কমান্ড করলেন, ‘ফায়ার’। তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জে উঠল। এতে মারা গেলো পাঁচ পাক সেনা। পরে  ক্যাম্পে গিয়ে জীবিত আরেক পাক সেনাকে পেয়ে তাকেও গুলি করে হত্যা করেন মকবুল বাহিনী। শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস। এইদিনই বিকেল চারটায় পাক সেনাদের বিশাল একটি বাহিনী ১৮টি গাড়ি নিয়ে রূপগঞ্জ থানার গাউছিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ঘটনাস্থলে যান প্রতিশোধ নিতে। কাউকে না পেয়ে পাক সদস্যরা গাউছিয়া ও গোলাকান্দাইল এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করলে বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ফাইটার জসীম, ঢাকার তাস মুরাদ, কমান্ডার মাসুদসহ অন্যরা গতিরোধ করলে তুমুল যুদ্ধ হয়। উভয় গ্রুপের দলের মাঝখানে খাল ও ধানক্ষেত থাকায় পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয় পাক বাহিনীর ক্যাম্প।

এদিকে, নরসিংদী থেকে যেসব যাত্রীবাহী গাড়ি ঢাকা ডেমরায় যাতায়াত করতো, সেসব গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করতো এক পাক সেনা। সেই পাক সেনাকে ১২ নভেম্বর হত্যা করেন মকবুল হোসেন দলের সদস্য নুরুল ইসলাম। ওইদিন একটি স্টেনগান কাপড়ের নিচে লুকিয়ে গাড়িতে চেপে বসেন নুরুল। চাঁদাবাজ পাক সেনা ওই গাড়িতে উঠতেই স্টেনগানের মুখে তাকে জিম্মি করে তাকে আটক করে ফেলেন। গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর মকবুল হোসেন ও তার দল আদমজীতে পাক হানাদার বাহিনী এবং বিহারীদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ভূঁইয়া এবং তার দলের সদস্যরা ঢাকাতে প্রবেশ করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২ এপ্রিল ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একজন হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মকবুল হোসেন ভূঁইয়াকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একশত টাকা করে সম্মানি ভাতা দেয়া হয় এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে সংসদ উন্নয়নের জন্য দশ টাকা করে চাঁদা কর্তন করা হয়। ২নং সেক্টরের সহ অধিনায়ক মেজর হায়দার স্বাক্ষরিত এ রশিদ এখনও মকবুলের কাছে স্মৃতি হয়ে আছে। তার নাম ভারত থেকে আনয়নকৃত ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খণ্ডকালীন তালিকার ১নং ভলিউম এর ২৩৯৫-ক্রমিকে অন্তর্ভূক্ত এবং ভারতের উম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টারে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণরত সদস্য নং-৪৭৫, যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদপত্র ম-১৬৫৫৬, মুক্তিবার্তা-০১০৪০৪০২২৪ এবং মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী কর্তৃক প্রদত্ত সনদপত্র নং-১৪৬৩২৪।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।