একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহংকার, বর্ণিল ঐশ্বর্য বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বাঙালি এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা।
শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনই নিবেদিত দেশ জাতি ও জনগণের জন্য। জীবনের পুরো পথ পরিক্রমায় বাঙালির সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাকার ছিলেন। নিরন্ন, দুখী, অভাবী, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জাতির দুর্ভোগ মোচনে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে অগ্রসেনানীর দায়িত্ব পালন করেছেন। দাঙ্গাপীড়িত বাঙালি-অবাঙালিকে রক্ষায় জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গিয়েছেন। লোভ; মোহের ঊর্ধ্বে ছিলেন বলেই শাসকের নানা প্রলোভন উপেক্ষা করে দুঃসাহসে প্রতিবাদ প্রতিরোধী হয়েছেন। দিনের পর দিন কেটেছে কারাগারে। লৌহকপাটের অন্তরালে কখনো ভেঙ্গে পড়েননি। হতাশা গ্রাস করেনি। শাসকদের সমঝোতার পথকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সগর্বে ঘোষণা করেছেন; ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না। ’ সেই সাহসী উচ্চারণ অহেতুক ছিলো না। প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা সহজ সাধ্য নয়। আর তা বলতে পেরেছেন এই কারণে যে, এই ঘুমন্ত জাতিটিকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ হিসেবে জেনেছেন তিনি। ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শিরা উপশিরায় রক্তপ্রবাহের উত্তাপ বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন, তাই জাতিকে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু স্কুল জীবন থেকেই স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক ছিলেন। হিন্দু, খৃস্ট্রান এবং মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে বেড়ে ওঠেছেন, তাই জন্মগতভাবে অসম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেছেন। মক্তবে ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন পাঠ করেছেন। কারাগারের জীবনে এবং পাকিস্তানী কারাগারে একাত্তরের নয়মাস বন্দিজীবনকালে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কিন্তু কখনোই ধর্মান্ধ ছিলেন না। পড়েছেন মিশনারী স্কুলে। তাই ইংরেজি ভাষা ছাত্র জীবনেই চর্চা করেছেন। এ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন বলেই এবং মেধাবী হিসেবে সে সময়ের কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। আইন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালেই বহিষ্কৃত হন। অপরাধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সমর্থন দান। মূলত এটি ছিলো অজুহাত। শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ তখন থেকেই পাকিস্তানী শাসকদের বাঙালি বিরোধী তৎপরতা রুখে দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো।
১৭ বছর বয়সে ‘নেতাজী সুভাষ বোসের’ সান্নিধ্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্থানীয় জনগণের সমস্যা সমাধানের দাবিতে তিনি যখন অগ্রসরমাণ, তখন রাজনৈতিক গণ্ডির পরিধিতে ক্রমশ প্রবিষ্ট হতে থাকেন। গোপালগঞ্জে পড়াকালে যে স্বাধীনচেতা মনোভাব তৈরি হয়েছিল, কলকাতায় তা আরো প্রসারিত হয়। সেখানে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলে। সাহস ও যোগ্যতায় তিনি সমকালীন অনেককে ডিঙিয়ে পাদপীঠে চলে আসেন। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে মুসলীম লীগ। তখনকার সময়ের রাজনীতিতে শেখ মুজিব তার গুরু সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলীম লীগে যোগ দেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর দেখেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা শাসন ক্ষমতার সর্বত্র। পূর্ববঙ্গবাসীকে পদানত করে রাখার সব আয়োজন চালাচ্ছে। এমন কি বাঙ্গালীর মুখের ভাষা ‘বাংলা’ কেড়ে নিয়ে ভিনদেশি ভাষা প্রচলনের প্রচেষ্টা শেখ মুজিবকে ক্ষুব্ধ করেছিল বৈকি। ধীরে ধীরে তিনি এই বঞ্চনা, শোষণ এবং জাতি হিসেবে বাঙ্গালীকে পদানত করে রাখার বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ষ্পষ্ট হয় যে, এক ব্রিটিশ শোষণ থেকে পাকিস্তানী বেনিয়া শোষকদের হাতে পড়েছে বাঙালি। রাষ্ট্র ক্ষমতার কোথাও বাঙালির প্রবেশাধিকার নেই। এমন কি নিজেদের শাসন করার অধিকারটুকুও পাকিস্তানী শাসকরা কব্জা করে রেখেছে। উপলব্ধি হলো, পূর্ববঙ্গবাসী দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান মানুষের এই মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত।
পূর্ববঙ্গের কৃষকের উৎপাদিত পাটসহ অন্যান্য পণ্য বিদেশে রফতানি করে যে আয় হয়, তার পুরোটাই পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ও শিল্পায়ণে ব্যয় হচ্ছে। পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবন আরেক পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ছে। কৃষিজীবি, শ্রমজীবি, মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার উৎসগুলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করলেন যে, পূর্ব বাংলার মানুষ অনুভব করে যে, পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানানো হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হওয়া সত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মোহমুক্তি ঘটতে শেখ মুজিবের সময় লাগেনি। তাই মুসলীম লীগ বিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ মুসলীম লীগ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন তারও একজন নেতারূপে দেখা দিলেন শেখ মুজিব। গড়ে তুললেন শক্তিশালী বিরোধী দল। বইয়ে দিলেন দেশজুড়ে আন্দোলনের জোয়ার। সেই জোয়ার বাংলার মাঠ, ঘাট, প্রান্তরে প্রবাহিত হতে থাকে। স্বজাত্যবোধ ক্রমশ তৈরি হতে থাকে গণমানুষের মধ্যে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে মুসলীম লীগ যে পন্থা নিয়েছে, শেখ মুজিবসহ অন্য নেতারা এর বিরোধিতা করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টির বহু চেষ্টা হয়েছিল। নির্বাচন হলো এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেন। তার সমালোচকরা বলল, এবার তিনি আপোস করবেন। কিন্তু আপোস হয়নি। সারা পৃথিবী সংগ্রামের এক নতুন রূপ দেখেছিল। সেদিন এ সংগ্রামে সারা দেশের মানুষ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স পঞ্চাশ বছর। তাঁর চেয়ে বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ নেতা অনেক ছিলেন দেশে। মানুষ কিন্তু বঙ্গবন্ধুকেই তাদের নেতা বলে, তাদের স্বার্থের রক্ষক বলে জেনে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অন্তত মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ট আসন পেলেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও তাদের দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তোলা হলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। আলোচনার টেবিলে পাকিস্তানীরা নানা আপোষের ফর্মূলা দিলেও বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপোষে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, পাকিস্তানীদের সঙ্গে আর বসবাস সম্ভব নয়। জোড়া তালি দিলেও মনস্তাপে মেলানো যাবে না।
সুতরাং ছয় দফা দাবিকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক দফা ঘোষণা করলেন। এবং তা স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। সারা বাংলাদেশ গর্জে উঠলো সেই ডাকে। পাকিস্তানের সংগে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে গেল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি। উঠে এলো ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নতুন রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনকালে পুরো জাতি একটি বিন্দুতে এসে স্থির প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে— তা হচ্ছে স্বাধীনতা। পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধিকারের দাবি থেকে স্বাধীনতার দাবিতে পৌঁছে গেছে ততোদিনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পশ্চিমা সংবাদ পত্রে বলা হলো ‘ভয়েস অব বেঙ্গল’। সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু তখন বাংলার কন্ঠস্বর। সাত মার্চের ভাষণে তিনি পুরো জাতিকে তার স্বাধীনাতর জন্য করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিলেন।
আজ দশ জানুয়ারি। এই দিনে তাকে স্মরণ করি হৃদয়ের গভীরতর অনুভূতি দিয়ে। যতদিন বাঙালি জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবে, ততোদিন থাকবেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার মাটি, আকাশ, পানি, প্রকৃতি চিরদিন তাকে স্মরণ করবে নিজেদের অস্তিত্বের কারণেই। জয়তু বঙ্গবন্ধু।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫