চীন এখন পর্যন্ত অর্থনীতির দিক থেকে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। অর্থনীতিকে কূটনীতির সাধারণ সূত্র ধরে দেশটি আগের বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
ইতিমধ্যে বেইজিং কর্তৃপক্ষ চীন-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপের মধ্যে সমুদ্রপথে পরিবহন করিডোর নির্মাণের প্রক্রিয়া আগায়ে নিচ্ছে। যেটি ম্যারিটাইম সিল্ক রোড (সমুদ্রভিত্তিক বাণিজ্য পথ) নামে পরিচিত। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ একইসঙ্গে এটি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ তৈরি করবে। অপর রুটটি হলো স্থলপথে। যেটি মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে। সর্বশেষ নেপালের সঙ্গেও নতুন সিল্করোড বা বাণ্যিজ্যিক রুট গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে চীন। দক্ষিণ এশিয়াব্যাপী বড় ধরনের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
মূলত এ দুটি বড়ধরনের রুটই দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে। যদিও এখন পর্যন্ত রুট দুটির নকশার কাজও করা হয়নি। এখনো এটি আঞ্চলিকভাবে অংশীদার রাষ্ট্রগুলোকে রাজি করানো এবং পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। ভারত এই রুটের ব্যাপারে ভিতরে ভিতরে রাজি থাকলেও চীন বেশ জোরেসোরে দিল্লির প্রশাসনকে খাতির করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো প্রতিবেশি দেশগুলো এই সিল্করোডে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। ভারত বেশ আগে থেকেই নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় তাদের বাজার সম্প্রসারণ করে নিয়েছে। ভারতের বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক উদ্যোগ বহাল থাকা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো এই দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে চীনকে আরো ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে শামিল করতে অস্বস্তি বোধ করছে না।
সিল্করোডটিতে যুক্ত হলে পরে এসব প্রতিবেশি দেশের বাজার ও বাণিজ্যে চীনের উপস্থিতি জোরদার হবে এমন প্রবণতা নিয়ে ভারত খুব সতর্ক। কিন্তু তারপরও দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশে বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে চীনের নতুন ধরনের এ উদ্যোগে ভারত সহযোগিতা দিয়ে যাবে। ভারত চাচ্ছে দ্রুত এই সিল্করোড গড়ে উঠুক। ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদির সরকার চীন-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে।
জাপান ভিত্তিক কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী ‘দি ডিপ্লোমেট’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অখিলেশ পিল্লালামারি জানান, পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির সাথে এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক যোগাযোগ ও সমন্বয় বাড়াতে শুরু করবে। বিশেষভাবে এক্ষেত্রে চীন এগিয়ে থাকবে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো স্বতন্ত্র একটি ব্লক হয়ে তা না করতে পারলে তবে চীন একাই তা করে যাবে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও একটি ব্লক হিসেবে কোনো একটি সংস্থার পক্ষে অর্থনৈতিক যোগাযোগ গড়ে তোলার সম্ভাবনা নেই। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগিতামূলক সংগঠন আশিয়ানের মধ্যে এ সম্ভাবনা ছিলো কিন্তু তারপরও এখন তা সম্ভব না।
আশিয়ানের মতো সহযোগী সংস্থার পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একটি অর্থনৈতিক ব্লক গড়ে তোলা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মানে যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের স্বার্থ বজায় রেখে অর্থনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ রাখবে সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
অখিলেশ মনে করেন, এই সম্ভাবনা না থাকা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ না থাকার প্রধান কারণ হলো, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিকে মুক্ত রাক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের যে যথেষ্ট ভূমিকা থাকার কথা ছিলো তা ব্যর্থ হয়েছে। একইসঙ্গে পাকিস্তানের অস্পষ্ট ও দোদ্যুল্যমান নীতিও এর জন্য দায়ী। যেকারণে এককভাবে চীনের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে এগিয়ে থাকায় এ অঞ্চলের অপরাপর দেশগুলোসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি নিরাপত্তার দিক থেকে সংকটাপন্ন।
তবে ক্ষমতায় আসার পর মোদির ভূমিকা আশা ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বাণিজ্যকে প্রধান গুরুত্ব দিচ্ছে মোদির সরকার। সেজন্য মোদি তার প্রশাসনও সেভাবে সাজিয়েছেন। সংস্কার করেছেন ব্যাপকভাবে। যদিও ভারতের গত অন্তত ১৫ বছরের ইতিহাসের দিক থেকে এই উদ্যোগ খুব বেশি উল্লেখযোগ্য কিছু না। মানে এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও এর প্রভাব পড়বে খুবই ধীর গতিতে। এমনটাই মনে করছেন অখিলেশ।
যাইহোক, নেপাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এই বাণিজ্যিক রুটে যোগ দেবে এবং যাবতীয় সহযোগিতা দেবে। গত মাসেই এই সিল্করোড বাস্তবায়নে চীন ও নেপালের মধ্যে চারটি পয়েন্টে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সম্প্রতি চীন তিব্বতে বিশাল রেল সংযোগ স্থাপন করেছে। তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে সিগাতসে প্রদেশ পর্যন্ত এই রেলসংযোগ তৈরি করা হয়েছে। নেপাল ও ভারতের সাথে চীনের যে সীমান্ত রয়েছে তা থেকে মাত্র ২৫৩ কিলোমিটার দূরে সিগাতসের প্রাদেশিক শহরটি। শিগগিরই নেপাল এই রেলসংযোগে যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটি। নেপালের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সাথে যুক্ত হবে এই রেলসংযোগ। এক পর্যায়ে রাজধানী কাঠমাণ্ডুতেও যুক্ত হবে এই রেল লাইন। অবশ্য ভারতের জন্যও করিডোর হিসেবে এই রেল যোগাযোগ খুবই সম্ভাবনাময়।
ধারণা করা হচ্ছে, চীনের তৈরি এই দুই মহাদেশীয় (এশিয়া-ইউরোপ) সিল্করুট এশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। যেটা শেষ পর্যন্ত শুধু আর অর্থনীতির ব্যাপার হয়ে থাকবে না, রাজনীতি ও কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।
নেপালের নগদ সুবিধা হলো, কাঠমাণ্ডু কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের পণ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বাজারেও নিয়ে যেতে পারছে। এতে করে দীর্ঘদিনের রাজনীতির অস্থিতিশীলতা থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া দেশটি দ্রুত তার অর্থনীতিতে একটা ভালো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে নেপালের অবস্থান একেবারে নাই বললেই চলে, আঞ্চলিকভাবেও বেশ দুর্বল। আঞ্চলিকভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতই এখন পর্যন্ত নেপালের আন্তর্জাতিক বাজার। যদিও সম্প্রতি নেপাল ভারতের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে। ভারতের ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদী আসার পর দিল্লির সাথে কাঠমাণ্ডুর সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো।
বরাবরই ভারত নেপালের রাজনীতিতে প্রধান প্রভাবশালী ফ্যাক্টর ছিল। কিন্তু এতো কাছাকাছি থাকার পরও নেপালের অর্থনীতিতে ভারতের প্রভাব চীনের তুলনায় দুর্বল। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বিপর্যস্ত দেশটির অবকাঠামো উন্নয়নে চীন ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে। যেটা ভারত করতে পারেনি। সেকারণে চীনের বিনিয়োগেই নেপাল তার সুবিধাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে মোদীর ক্ষমতায় আসার পর নেপালের প্রতি বেশ মনোযোগ দিয়েছে দিল্লির প্রশাসন। মোটকথা নেপালের সংযোগের ফলে চীনা সিল্করুট ইস্যুটি এমন এক জায়গায় চলে গেছে যেটার কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব না।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশে চীনের তৈরি সিল্করুট প্রকল্পের শুরুতে নেপালের যুক্ত হওয়াটা বড় ধরনের একটি মাইলফলক বটে। কারণ প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য এটি বড় ধরনের সম্ভাবনা হওয়া সত্ত্বেও নেপাল ছাড়া কেউ প্রথমে এগিয়ে আসেনি। ছোট অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের জন্য এই সিল্করুট বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের জন্যও এটি বাণিজ্য ও অর্থনীতির দিক থেকে অনেক সুযোগ তৈরি করবে।
কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে এমনকি সাংস্কৃতিক দিক থেকেও ভারত চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় দিল্লি সহসায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। অর্থনীতির দিক থেকে এ ক্ষেত্রে ভারত একটা সুবিধা নিতে পারে। মানে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে শুধু রাজনীতির দিক থেকে নয়, অর্থনীতির দিকে থেকে বোঝাটা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে চীনের চ্যালেঞ্জিং উপস্থিতিকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করাটাই এখনকার কর্তব্য হয়ে উঠেছে। মানে ভারতের দিক থেকে এ মুহূর্তে চীনকে মোকাবেলার একমাত্র পথ হলো এশিয়ার অর্থনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫