ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কোথায় চলেছে পথহারা, দিশেহারা বিএনপি?

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫
কোথায় চলেছে পথহারা, দিশেহারা বিএনপি?

কি চায় বিএনপি? সারাটা দেশ যখন বোমায়-আগুনে পুড়ছে? যখন বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে নিরপরাধ অসহায় সাধারণ মানুষ? মানুষ পোড়ানোর পৈশাচিকতাকে যারা বলছে ‘আন্দোলন’ কেমনতরো দল তারা? ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটকে সারাদেশের মানুষের সম্ভাব্য ঠিকানা বানিয়ে ফেলার এই অপ-রাজনীতি কেন চালু করলো বিএনপি?এমন সর্বনাশা রাজনীতি চালু করার দায় কাঁধে নিল, কেনই বা এমন ক্ষ্যাপার মতো আচরণ করছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটি? বিএনপির রাজনীতির নিজস্ব মৌল চেহারাটি উবে গিয়ে কেন সেখানে উঁকি দিচ্ছে জামায়াতের ভয়ানক করাল চেহারা?

জামায়াতের মতো রগকাটা, হাতকাটার বীভৎস  রাজনীতির বিপজ্জনক পথে হাঁটতে হাঁটতে বিএনপি কেন হয়ে উঠতে চাইছে আরেক জামায়াত! আন্দোলনের এমন নারকীয় কৌশল কেন বেছে নিল দলটি? শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বলতে কিছু কি আর নেই এ-দলের? আন্দোলন মানেই ‘মানুষ পোড়াও, গাড়ি জ্বালাও, মারো বোমা ককটেল’? স্বাভাবিক স্রোতের বিপরীতে, শুভবুদ্ধির বিপরীতে ধর্মান্ধ জঙ্গিদের মতো কেন চলছে, কোথায় চলছে বিএনপি?

এভাবে দিকভ্রান্তের মতো জামায়াতি রাজনীতির টোলের-মুরিদ-বনে-যাওয়া বিএনপির যেন ঘটে গেছে এক দু:খজনক, আত্মধ্বংসী, নেতিবাচক বিবর্তন; হ্যাঁ, তবে তা উল্টোদিকের বিবর্তন। এই বিবর্তন বিকাশের বদলে অবক্ষয়ই ডেকে আনে শুধু।

বোমাই যদি হয় আন্দোলনের ‘মোডাস অপারেন্ডি’ তাহলে অবক্ষয়ই তো তার অনিবার্য পরিণতি! আজ বার্ন ইউনিটের হৃদয়বিদারক দৃশ্যের কথা স্মরণে নিয়ে একথা বলবার সময় এসে গেছে: বাংলাদেশের রাজনীতির সবচে বড় অবক্ষয়ের অন্য নাম বিএনপি।

নিরপেক্ষ নির্বাচনের অধিকার আদায়ের নামে সরকারের বিরুদ্ধে ঝাল মেটাতে গিয়ে তারা চলছে নিজেদের হঠকারি খেয়াল-খুশিমতো; যেমন চলে পথের পাগলা ক্ষ্যাপা। যখন-তখন হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি তারা দিয়েই চলেছে লাগাতার—মানুষ তা মানুক আর না-ই মানুক। অনেক সময় কি কারণে অবরোধ-হরতাল ডাকা হলো তা-ও স্পষ্ট করতে পারছে না দলটি। এমনও দেখা গেছে, সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে পানি-বিদ্যুতের কষ্টের কথা বলছেন বিএনপিনেত্রী। যেদিন বললেন দেখা গেল সেদিনই সারাদেশে স্মরণকালের সবচে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। কোথাও পাওয়ার আউটেজের ঘটনাই ঘটেনি। (খালেদা ভুলে গেছেন, তার  সময়ে এক মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন তারা করতে পারেন নি। পেরেছিলেন কেবল খাম্বা কিনতে। তারেক-মামুনের খাম্বা লিমিটেডের কথা মানুষ ভোলেনি)। খালেদা জিয়ার ভাষণগুলো অনেক সময় এরকম হাস্যকর, মিথ্যা আর মনগড়া বক্তব্যে ঠাসা থাকে। কাজে-কথায় হাস্যকর বৈপরিত্যের মধ্য দিয়েই দিকভ্রান্তের মতো হাঁটছে বিএনপি। কি চায় কেন চায় কি তাদের মোক্ষ সেসবের কিছুই খালেদা জিয়ার নিজেরই যেন জানা নেই।

বিএনপির গত কয়েক বছরের রাজনীতির হালহকিকত দেখে এটিকে আর কোনো রাজনৈতিক দল বলেই মনে হয় না। লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন-মোক্ষহীন-এজন্ডাহীন, দিকচিহ্নহীন এক ঊন-দলে, নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়ে বিএনপি এখন পালহীন নৌকার মতো গতিহারা, দিশেহারা। নেতাদের মধ্যেও নেই কোনো সমন্বয় বা যোগাযোগ। স্লিপ অব টাং বা মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা কথা থেকেও যে-দল অবরোধ চাপিয়ে দেয় জাতির ঘাড়ে, তাদের রাজনীতি আর যা-ই হোক গণতন্ত্রের সাথে যায় না। ব্যক্তিপূজা আর সামন্তবাদী মানসিকতা দিয়ে গণতন্ত্রের ‘ট্রয়কা’ চলে না। গণতন্ত্রের ‘ট্রয়কা’ চলে জনসমর্থনের ফুয়েলে আর মজবুত গণভিত্তির মসৃণ চাকায়। আজকের বিএনপির সে দিকটায় খেয়াল আছে বলে মনে হয় না।

 অবরোধের কর্মসূচিই নেই অথচ অতি-উৎসাহী সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে বিএনপিনেত্রী মুখ ফসকে যেই না বলে ফেললেন ‘অবরোধ চলবে’, তাতেই শুরু হয়ে গেল টানা অবরোধ, টানা জ্বালাও-পোড়াও, টানা বোমাবাজি, বাছবিচারহীন লাগাতার খুনখারাবি। অথচ অবরোধ বলে কোনো কর্মসূচিই তো ছিল না বিএনপির! কিন্তু দলকানা নেতাকর্মীদের কাছে যে ম্যাডামের কথা অমৃত সমান! তাই নেত্রীর মুখ-ফসকে-যাওয়া কথাকেই অবম্যমান্য বলে ধরে নিয়ে ‘‘রাজা যতো্ বলে পারিষদ শতগুণ’’মন্ত্রে দীক্ষিত, বিবেকহীন-কাণ্ডজ্ঞানহীন বিএনপি নেতাকর্মীরা সারাদেশে পথচলতি মানুষের উপর শুরু করে দিল আগুনের উৎপাত। বাস পুড়ছে, ট্রাক, রিকশা, টেম্পু, স্কুলযান আর পুলিশের গাড়ি--- কিছুই বাদ পড়ছে না। দুধের শিশু, নারী, বৃদ্ধ, খেটেখাওয়া মানুষ---সবার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা এক ক্ষ্যাপার দলে পরিণত হয়েছে যেন বিএনপি। পেট্রোলবোমায় শরীর ঝলসে যাওয়া একটা ছোট্ট বাচ্চা হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে আর ডাক্তার-নার্সসহ যে-ই কাছে আসছে তাকেই বলছে ‘‘ব্যাটারা আমারে পোড়ায় দিছে। ক্যান পোড়ায় দিছে? আমি তো কোনো দুষ্টামি করি নাই! আমারে ক্যান পোড়ায় দিছে? আমার যে খুব কষ্ট!!’’।

সারা বাংলাদেশ যেন এই শিশুটির মতোই বলছে: দেখে যাও হঠকারী, নৃশংস, বীভৎস, পৈশাচিক রাজনীতির কুশীলবেরা আমাদের ‘পোড়ায় দিছে’। মানুষ পুড়িয়ে মারায় আনন্দ যারা পান তারা চালাবেন দেশ আর করবেন মানুষের কল্যাণ? আমড়াকাঠে চন্দনসুরভি পাবার মতোই অলীক কল্পনা! স্বাভাবিক মৃত্যুর বেদনাই তো মানুষ সইতে পারে না। খালেদা জিয়া নিজেও তো এখন তার পুত্রের মৃত্যুবেদনার গুরুভার সইছেন। মা হিসেবে সন্তানের লাশ দেখার মতো কঠিন দু:সহ দুর্বহ বেদনা তাকে সইতে হচ্ছে। তিনি যদি একবার ভাবতেন তার ডাকা অবরোধের বোমায়-আগুনে কতো মা তাদের সন্তান হারাচ্ছেন? সেইসব মায়ের বুকের হাহাকার কতো অসহ্য আর অসহনীয় তা যদি একবার ভাবতেন! পুত্রহারা মা হিসেবে অন্য মায়েদের মর্মযাতনা কি তাকে স্পর্শ করে না, করে নাকি?
তার বেলায় তো আর এটা বলার আর অবকাশ নেই ‘‘কভু আশীবিষে দংশেনি যারে...’’! তিনি নিজেই যে আজ পুত্রের মৃত্যুর করাল বেদনায় মূহ্যমান। তবু কেন তিনি বলছেন না: ‘অনেক হয়েছে, এবার জ্বালাও-পোড়াও থামাও!’’

মানুষ মেরে যে সুস্থ-স্বাভাবিক রাজনীতি হয় না ---একথা বিএনপিকে কে আর বোঝাবে! বিএনপি যে রাজনীতি শুরু করেছে তাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা আর নেকড়েকে মেষশাবক বলা সমান কথা। গণতন্ত্র মানেই অন্যের অধিকার খর্ব না করে নিজের পছন্দমতো চলার,বাঁচার অধিকার। সেই অধিকারকেই কেড়ে নেবার সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে আজ বিএনপি। গণতন্ত্রে তো ‘রাজনৈতিক শত্রু’র অধিকারকেও স্বীকৃতি দিতে হয়; অথচ বিএনপি কেনই বা তাদের ভোটব্যাংক আর চিরকালের ‘মিত্র জনগণের’ অধিকারের গলা টিপে, টুঁটি টিপে ধরছে? চলার-বলার, বাঁচার-হাসার সব অধিকারের উপর বোমা, পেট্রোলবোমা মারার এই রাজনীতিতেই কেন মেতে আছে খালেদার দল? বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায় কোন পথে? নারী-শিশু-বৃদ্ধ, শ্রমিক-চাকরিজীবীর রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে? রক্তের লাল গালিচা বিছিয়ে কি আদৌ গণতন্ত্রের সুমহান লক্ষে পৌছা যায় কখনো? ‘লক্ষ্য’---বলে কোনো শব্দ কি বিএনপি নামে ক্রমশ-ক্ষয়ে-যেতে-থাকা দল বিএনপির আছে?

বিএনপি কি কখনো জনগণের সামনে স্পষ্ট করতে পেরেছে ক্ষমতাসীনদের ‘অপশাসনের’ বদলে তারা কিভাবে দেশ চালাবে সেই ফর্মুলা? তারা কি স্পষ্ট করতে পেরেছে কি তাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভিশন? কিভাবে তারা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে, কি তাদের পরিকল্পনা, কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি? প্রতিবেশীদের সাথে, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে, পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে কেমন হবে তাদের সম্পর্ক? তারা কি স্পষ্ট করতে পেরেছে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা স্বাধীনভাবে চলতে দেবে কিনা---বা কিভাবে দেবে? সেটা যদি তারা করতেই চায় তাহলে কিভাবে করবে? দুদক, ইসিসহ প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে চলবে তার কোনো ছক/পরিকল্পনা বা কর্ম-কৌশল কি খালেদা জিয়ার এবং তারেক রহমানের বা সিনিয়র নেতাদের আছে? না, কখনোই এসব সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি বিএনপি। তারা এখন নির্বাচনী নিরক্ষেতার বড় বড় বুলি আওড়ায়; অথচ তারাই এম এ আজিজের মতো এক নাটুকে স্বভাবের ‘বুড়ো ভাম’কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে দেশকে ঠেলে দিয়েছিল সর্বনাশের আবর্তে। অনেক রক্তপাত হানাহানি শেষে অবশেষে জাতির ঘাড় থেকে এম এ আজিজের মতো ‘ভাঁড়টিকে নামাতে বাধ্য হয় বিএনপি। ২ কোটির মতো ভুয়া ভোটার বানিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেবার খায়েস করা দল বিএনপির তাতেও টনক নড়েনি। এরপরও একের পর এক হঠকারিতার পথেই হেঁটেছে তারা। উদাহরণ দিলে সহজে ফুরাবে না। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা কেমন দু:শাসন জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তা মানুষ এতো সহজে ভুলে যায়নি, যাবেও না। পুরনো একটা প্রবাদ আছে: অন্যের পোশাকের সমালোচনা করবার আগে নিজের উদোম গায়ের দিকে তাকানোই নাকি সমীচীন কাজ। কিন্তু বিএনপির সেদিকে কোনো গরজ নেই । বরং সে রাজনীতির ক্ষ্যাপায় পরিণত হয়ে পথচলতি লোকদের দেখে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর বলছে: তোমরা সবাই ন্যাংটা। অথচ তার নিজের সারা গা যে উদোম সেটা সে জানে না। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’ কথাটা মনে রাখা সবচে বেশি দরকার আজ বিএনপির।

রাজনীতির নানা আলখাল্লাধারীদের দেখে জনগণ আজ বুঝে গেছে  বাইরের শোভন-নিপাট চেহারার আড়ালে রাজনীতি হয়ে উঠেছে কদর্য, নগ্ন আর ভীতিকর। প্রবাদের সেই শিশু যেমন রাজাকে দেখে বলেছিল, ‘’রাজা তুমি নেংটো!’’ ,ঠিক তেমনভাবে  মানুষও আজ বোমায়, আগুনে-ককটেলে পুড়ে, হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাতে কাতরাতে বুঝেছে রাজনীতি আর জনগণের ত্রাতা নয়, বরং সংহারক। রাজনীতি আজ আর মুক্তির উপায় নয় বরং বীভৎসতার উৎকট প্রকাশ। রাজনীতি আর কিছুই দেয় না; শুধু কেড়ে নিয়ে যায় সব কিছু ----প্রাণ, রক্ত আর ভবিষ্যতের আশা, স্বপ্ন। রাজনীতি, বিশেষ করে বিএনপির, বোমা-নির্ভর রাজনীতির পাশে গণতন্ত্র নামের তন্ত্রটিকে বড় হাস্যকর আর করুণ লাগে। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল সম্ভবত তার ‘আন পপুলার এসেজ’ বইয়ের কোনো এক প্রবন্ধে রাজনীতিকে বদমায়েশদের শেষ আশ্রয়স্থল বলতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির দিকে তাকালে তার কথার সত্যতা টের পাওয়া যায়। হাড়ে হাড়ে টের পেতে-পেতে গোটা দেশটাই হয়ে উঠেছে নরক। আমরা তো কেউই একুশ শতকে কোনো নরকের বাসিন্দা হতে চাই না---চাই না রাজনীতির নামে, গণতন্ত্রের নামে আমাদের কেউ পুড়িয়ে মারুক, চাই না বার্ন ইউনিটে কোনো অবুঝ শিশু বারবার আর্তনাদ করে বলুক ‘‘ব্যাটারা আমারে পুড়ায়া দিছে... আমার খুব কষ্ট!’ বাংলাদেশের মানুষকে এই পুড়ে মরবার ভয়াবহতা থেকে কখন রেহাই দেবে বিএনপি? আর কতো নরক গলজার করবার পর, আর কতো মায়ের বুক খালি হবার পর?  

বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।