‘জনগণের’ নাম করে আর তার দোহাই দিয়ে আমরা অনেক কিছুই বলে থাকি। কিন্তু জনগণ তো অবিভাজ্য নয়।
সরকারপন্থীদের একটি বড় অংশ অবশ্য বলার চেষ্টা করছে, দেশে কোনো সঙ্কট নেই। বিএনপি ও তার সহযোগীরা একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তাদের মতে, সরকার এটা দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর ওপর তারা খুবই আস্থাশীল। তারা এমনও মনে করেন—আন্দোলনের নামে যেটা চলছে, তা দুর্বল হয়ে পড়বে বা দমন করা হবে। আর বর্তমান সরকার পূর্ণ মেয়াদেই দেশ চালাতে সমর্থ হবে। এদিকে বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের বড় অংশ মনে করে, দেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক সঙ্কট বিরাজ করছে। এর কারণ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং এর মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান ‘অবৈধ সরকার’। তারা মনে করেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারাই জিতবেন। এর মানে, দেশ পরিচালনার অধিকার তাদেরই এবং এটা তারা প্রতিষ্ঠা করতে চান একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। এ দু’পক্ষের সবাই যে একেবারে একমত, তা নয়। নিজ নিজ শিবিরে বিভিন্ন মত রয়েছে; তবে তাদের মধ্যে গুণগত ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দিনের শেষে তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক ছাড়া আর কিছু নন। সমর্থিত দল বা গোষ্ঠীর প্রতি প্রকাশ্য সমালোচনা এদের মধ্যে নেই বললেই চলে।
এ দু’য়ের মাঝে যারা রয়েছেন, তাদের পছন্দের কোনো রাজনৈতিক দল, জোট বা প্লাটফর্মও নেই। এমন কিছু গড়ে তোলার প্রচেষ্টা যে অতীতে নেয়া হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেগুলো টেকেনি বা সুফল দেয়নি। কী কারণে টেকেনি, তা নিয়ে আলোচনাও কম। দুই নেত্রীকে ঘিরে দুটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দাপট এতটাই দৃশ্যমান যে, তৃতীয় কিছু নিয়ে উৎসাহও লক্ষণীয় নয়। ‘তৃতীয় শক্তি’ বলতে এখনও মনে করা হয় সশস্ত্র বাহিনীকে, সাম্প্রতিক অতীতে যারা ওয়ান-ইলেভেন ঘটিয়েছিলেন। সেটি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পর দুই নেত্রী ও তাদের পরিবার ঘিরে বিবাদের বাস্তবতাই নতুন করে সামনে এসেছে। আর কেবলই মনে হচ্ছে, এর কোনো বিকল্প নেই!
‘বিকল্প’ না থাকলেও একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে রয়েছে এর আকাঙক্ষা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বা গোষ্ঠীর ওপর বিরক্ত হলেও নির্বাচনে তারা আবার কোনো না কোনো দিকে হেলে পড়েন। সে অনুযায়ী ভোটও দেন। তা সত্ত্বেও এরা সাধারণভাবে মনে করেন, দু’দলের চরিত্র মোটামুটি এক। আগে কিছু তফাৎ থাকলেও এরশাদ পরবর্তীকালে তফাৎ অনেক কমে এসেছে দু’পক্ষে। প্রায় একইভাবে দেশ পরিচালনা করছেন তারা। অর্থনৈতিক কর্মসূচি বলা যায় অভিন্ন। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায়ও পার্থক্য কমে এসেছে। বিভিন্ন ইস্যুতেই কেবল রয়েছে ভিন্নতা। পরস্পরকে মোকাবেলার কৌশল বলা যায় অভিন্ন। আন্দোলনের ধরনেও এরা পরস্পরকে অনুসরণ করতে করতে এখন নাশকতাকেই আন্দোলন বলে চালিয়ে দিতে চাইছে।
এসব সমালোচনা করেও দলনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী কোনো অবস্থান নিতে পারছে না, যেহেতু তাদের আস্থাভাজন কোনো দল বা প্লাটফর্ম নেই। মিডিয়ায় এদের মনোভাব অবশ্য প্রকাশ করে থাকেন অনেকে। তাতে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে থাকা বিপুল জনতা তেমন প্রভাবিত হচ্ছে বলে মনে হয় না। ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোয় প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার দেখে বোঝা যাচ্ছে, জয়-পরাজয় যাই হোক—প্রধান দুই দল বা গোষ্ঠীর ‘কোর ভোট’ একইরকম থাকছে। গণতন্ত্রের জন্য এর ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনাও তেমন হচ্ছে না। এটি যে একটা বাস্তবতা, সেটা বিস্মৃত হওয়ার প্রবণতাই বরং দেখা যাচ্ছে। সুশীল সমাজেরও অনেকে তাই বলে বসেন, ‘জনগণ’ এটা চায় বা ওটা চায় না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম কথা হল শুরুর কথাটা যে, জনগণ তো অবিভাজ্য নয়। দ্বিতীয় কথা, তিনি বা তারা কেবল বলতে পারেন দেশে দলনিরপেক্ষ বলে পরিচিত যে এক চিলতে জনগোষ্ঠী রয়েছে—তাদের কথা। এরাও সবাই কিন্তু দুই প্রধান দলের প্রতি ‘সমদূরত্বের নীতি’ নিয়ে সব সময় থাকছেন না। সেটাই স্বাভাবিক। যেমন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রশ্ন এলে দলনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠীর বড় অংশই মোটা দাগে এর পক্ষে অবস্থান নেন।
সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের উত্থানের ভীতিও রয়েছে তাদের মধ্যে এবং এক্ষেত্রে বিএনপিকে তারা মিত্র ভাবতে পারছেন না। শুধু এই একটি কারণে মধ্যবর্তী অনেককে দেখেছি এমনকি ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিতে। তাদেরই একাংশ আবার মনে করে, সরকারে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক কর্তৃক সমর্থিতদের শাসন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হলেও এরা তাই মনে করেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটা ব্যবস্থা হওয়া চাই আর সে লক্ষ্যে সংলাপের প্রক্রিয়া অন্তত শুরু করা দরকার।
সুতরাং দেশের দলনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠীকেও অবিভাজ্য ভাবা যাবে না। পছন্দের দল বা প্লাটফর্ম না থাকায় এবং নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে বেশি পরিচালিত হওয়ায় এদের চিন্তায় বৈচিত্র্য বরং বেশি। তবে সাধারণভাবে তারা শুধু নির্বাচন নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে। সরকারের জবাবদিহিতা, বিরোধী দলের সহিষ্ণুতা এবং ভিন্নমতের চর্চা বাড়ানোর পক্ষে। শুধু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এগুলো অর্জন সম্ভব বলে তারা মনে করতে পারছেন না। এ লক্ষ্যে অভাবনীয় সহিংস আন্দোলনও স্বভাবতই সমর্থন করছেন না তারা। এমনতরো আন্দোলনের জন্য তাদের অনেকে অবশ্য সরকার পক্ষের মনোভাব ও আচরণকেই প্রধানত দায়ী করেন। একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও বিরোধী দলকে তারা ‘স্পেস’ বা জায়গা দেয়ার পক্ষে। এক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে বক্তব্য মিলে যাচ্ছে বলে অবশ্য সরকারপন্থীদের গাল খেতে হচ্ছে তাদের। বিরোধী দল আবার তাদের দাবি ও আন্দোলনের প্রতি ‘পূর্ণ সমর্থন’ না জানানোয় দলনিরপেক্ষদের দোষারোপ করছে। মধ্যবর্তীদের পছন্দের দল বা প্লাটফর্ম গড়ে না উঠলে এমন পরিস্থিতিতে আরও বেশি করে পড়তে হবে তাদের।
এদের উদ্দেশে প্রায়ই বলা হচ্ছে, মাঝামাঝি অবস্থান নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মাঝে একটা অবস্থান তো রয়েছে। সেটা হল গণতন্ত্রের পক্ষে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে অবস্থান। সেটি গড়ে উঠলে অন্তত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না বারবার। রাজনীতিতে একটা আচরণবিধিও গড়ে উঠবে। তাতে বদলাবে এর সংস্কৃতি। পরস্পরকে নিঃশেষ করে দেয়ার বদলে শুধু দুই নয়, বরং অনেককে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতেও আমরা কি এমনটাই বুঝতে চাইব না?
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৫