ঢাকা: তোমরা এতো হিংসুটে কেন? হাসতে হাসতেই বলল বাইশ বছরের ক্রিস্টিনা। উচ্চশিক্ষিত আর স্মার্ট হয়েও একজন মধ্য বয়সী লোকের চতুর্থ স্ত্রী হতে কেন রাজি হলে- এমন প্রশ্নের হিংসুটে আর সংকীর্ণমনা অভিযোগ শুনতে হল।
পশ্চিম আফ্রিকার অনন্য সুন্দর দেশ গাম্বিয়া’র অজপাড়া গ্রাম বাস্সে (BASSE) বসে কথা হচ্ছিল ক্রিস্টিনা’র সঙ্গে। সেখানে আমার গবেষণাসঙ্গী সে। মধ্যবয়স্ক স্বামীর চতুর্থ বউ হিসেবে সংসার শুরু করেছে মাত্র মাসখানেক আগে।
পেশায় নার্স ক্রিস্টিনা নিজ দেশে উচ্চশিক্ষিত নারীদের একজন। কাজের সুবাদে তাকে আমি যেটুকু জানি, সাধারণ গাম্বিয়ান নারীদের তুলনায় অনেক বেশি স্মার্ট। কিন্তু এমন মেয়ে কেন কোনো মধ্যবয়স্ক লোকের চতুর্থ স্ত্রী হয়ে থাকবে? প্রশ্নটি মাথা থেকে যাচ্ছিলই না।
পশ্চিম আফ্রিকার আরও অনেক দেশের মত গাম্বিয়াতে বহুবিবাহ এতোটাই প্রচলিত যে, এর বিপরীতে কথা বলাটাই সংকীর্ণতা। তবুও পাল্টা প্রশ্ন করি: তোমার কি মনে হয় না এই প্রথা বদলানো উচিৎ?
ক্রিস্টিনার সোজা এবং আত্মবিশ্বাসী উত্তর: আমার মা-নানি– দাদি সবাই তো এভাবেই চলেছে। আমি কেন এটার বাইরে যাব? তাছাড়া স্বামীর যত বেশি স্ত্রী, তত বেশি সংসার থেকে ভারমুক্তি!
এরপর বহুবিবাহের পক্ষে আরো কঠিন যুক্তি দেখিয়ে বলল: আজ যদি আমার বাড়িতে কয়েকজন কাজের সহকর্মী না থাকত, তুমি কি তোমার গবেষণার কাজে আমাকে পেতে?
ক্রিস্টিনার আত্মবিশ্বাসী উত্তর আমাকে ভাবিয়ে তোলে। গাম্বিয়ার মতো আফ্রিকার অনেক দেশে নিয়ম হচ্ছে, স্ত্রীরা বাড়ির সব কাজ করবে, অনেক সন্তান জন্ম দেবে, তাদের দেখভাল করবে, আবার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কড়া রোদে মাঠে শস্যও ফলাবে। সে শস্য বাজারে বিক্রি করার দায়িত্বও নারীদের। শুধু কি তাই-রান্নার পাশাপাশি বাজার সদাইও করে নারীরা। তাহলে পুরুষের কি দায়িত্ব?
গাম্বিয়া’র রাস্তায় পথ চলতে চলতে প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখতাম বান্তাবাগুল(পাড়ার চা’র দোকান)সব সময় জমজমাট। পুরুষদের খুঁজলে বেশির ভাগ সময় পাওয়া যায় বানতাবায়। উল্লেখ রাখা দরকার—এখানে বহুবিবাহের প্রচলন কোনো বিশেষ ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এটা সামাজিক নিয়ম। তাই সবধর্মের পুরুষই বহুবিবাহের নিয়ম মেনে চলে।
ক্রিস্টিনা’র মনে একবারও এই প্রশ্ন জাগেনি—কেমন হতো যদি আমার স্বামী আমাকে বাসার এবং বাইরের কাজে সাহায্য করতো? বরং সে নিজেকে এবং স্বামীর অন্য স্ত্রীদের বাসার সহকর্মী ভেবে আত্মতুষ্টি পাচ্ছে।
ভাবছি ক্রিস্টিনা কি একা? আমি কি এই দৃষ্টিভঙ্গী আমার চারপাশে দেখিনি? আমি বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেট্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়(University of Maryland Baltimore) থেকে পরিচালিত শিশু-স্বাস্থ্য ও টীকা উদ্ভাবন বিষয়ক গবেষণার কাজে নিয়োজিত।
বিভিন্ন কাজে পৃথিবীর উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে যাবার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এর মধ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে আমাকে নিয়মিত যেতে হয়।
নিজের সংসার আর বাচ্চাদের রেখে কিভাবে দেশে বিদেশে তুমি ঘুরে বেড়াও?- আমার বন্ধুদের এমন প্রশ্নে বারবার জর্জরিত হয়েছি। কাজের প্রয়োজনে একজন নারী কোথাও গেলে সেটা হয় ঘুরে বেড়ানো। আর একই কাজে যখন একজন পুরুষ ঘরের বাইরে যায়, ওই বন্ধুদেরই বলতে শুনেছি ‘কত কষ্ট করে পুরুষ মানুষ বাসায় ফিরেছেন। ’ আলাদা যত্নও পান পুরুষরা।
আমার কাজের সম্মান, অধিকার আমাকে কেউ হাতে তুলে দেবে না, আমাকেই সে অধিকার অর্জন করে নিতে হবে।
যতদিন নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হবে, যতদিন শিক্ষা আর সামর্থ্যের আলোয় নারীর মনকে কুসংস্কার মুক্ত করা না যাবে, তত দিন জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থা নারীকে তার অধিকার এনে দিতে না পারবে, ততদিন ক্রিস্টিনারা এভাবেই সমাজের এই প্রথা ও নিয়ম মেনে চলবে; আর আমরা যারা অন্যভাবে চিন্তা করি, তাদের কাছে হবো সংকীর্ণমনা।
সভ্য সমাজের যা নিয়ম বা স্বাভাবিক, পর্যাপ্ত শিক্ষার আলোবঞ্চিত প্রথাগত কুসংস্কারের অন্ধকারে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে তা এখনও দুঃস্বপ্ন। এই বিবেচনায় বাংলাদেশে আমরা অনেক ভাল অবস্থায় আছি; কারণ এমন আত্মঘাতী সংকীর্ণতা আমাদের গ্রাস করেনি। কিন্তু আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সমাজের মনোভাব, বিশেষ করে পুরুষদের পাশাপাশি নারীর প্রতি নারীর মনোভাবও বদলাতে হবে।
নারী স্বাস্থ্যের বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের তুলনায় আমরা সামগ্রিকভাবে অনেক পিছিয়ে। তাই আমি যখনই সুযোগ পাই নারীদের সবার আগে মন ও দেহের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়ার তাগিদ দেই। নারীর সুস্থ মানসিকতা একটি সুস্থ সমাজ রচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পুরুষের উপর আপাত দৃষ্টিতে কতৃর্ত্ব করে নয়, নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ যেদিন নারী অর্জন করতে পারবে, সেদিন নারীমুক্তি হবে সঠিক অর্থে।
তাই আমার মেয়েকে প্রাত্যহিক কাজের বেলায় আমার প্রথম উপদেশ —মন আর শরীর সুস্থ রাখো। আর ছেলের বেলায়? অবশ্যই সুস্থ মন, সুস্থ শরীর—তার পাশপাশি সংযত রাখ তোমার দৃষ্টি আর মন। কারণ দৃষ্টি হচ্ছে মনের দরজা।
#পাদটিকা:
গাম্বিয়া থেকে প্রথম বার ফিরে আমার বন্ধুদের সাথে যখন আমার এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলাম, আমার পুরুষ বন্ধুদের একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন:বাংলাদেশের মেয়েগুলো কেন যে ক্রিস্টিনাদের মত উদার মানসিকতার হয় না! ভাবছি গাম্বিয়াতেই সেটল করব।
ড. দিলরুবা নাসরিন: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। পরবর্তী সময় আস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ANU) থেকে epidemiology তে PhD অর্জন করে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ এর ICDDR,B, হয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি (University of Maryland Baltimore) তে গবেষক হিসেবে কর্মরত। ড. নাসরিন Bill & Melinda Gates এর অর্থায়নে গাম্বিয়া, মালি, কেনিয়া, মোজাম্বিক, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণাকাজে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নেদারল্যান্ডসে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৫