বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্যায়ের একটা খেলা বাকি থাকতেই এই অনন্য সাফল্য পেয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে বাংলাদেশের জয় ছিল প্রত্যাশিত। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের বিশ্বকাপ মিশনে সামর্থ্য প্রদর্শনে বাংলাদেশ দলই ছিল এগিয়ে। খ্যাতনামা ইংলিশ ক্রিকেটবোদ্ধারাও বলেছেন বাংলাদেশের সম্ভাবনাই বেশি। সেদিক থেকে বাংলাদেশের জয়ে তেমন কোনো চমক নেই। তবে দেশের ক্রিকেটামোদীদের জন্য স্বস্তির ইশারা রেখেছে এই খেলা। প্রথমত দুই ওপেনার তামিম ও ইমরুল মাত্র ৮ রানে আউট হলেও ভেঙে পড়েনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই সাকিব আল হাসান। আকাশসমান ভরসা হিসেবেই তাকে ভাবা হয়। ব্যাটে তিনি করেছেন মাত্র ২ রান, আর বল হাতে একেবারেই ব্যর্থ। ক্রিকেটে এমন হতেই পারে এবং তা সাকিবের মতো নন্দিত ক্রিকেটারের জন্যও ব্যতিক্রম নয়। তবে দলগত খেলা ক্রিকেটে টসে হারা, ৮ রানে দুই ওপেনারের বিদায়- এমন বিপর্যয়ের পরও লড়াকু মনোভাব অক্ষুণ্ন্ন রেখে টাইগাররা তাদের নামের প্রতি সুবিচার করেছে।
প্রত্যাশার চেয়ে বেশি করেছেন মাহমুদুল্লাহ। প্রতিকূল অবস্থায় ব্যাটে নেমে তিনি ১০৩ রান করে বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সেঞ্চুরির খাতায় নাম লিখিয়েছেন। মুশফিকুর রহিম নিজেকে আবারও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন আস্থার প্রতীক হিসেবে। সাজঘরে তিনি ফিরেছেন ৭৭ বলে ৮৯ রান করে। দলের প্রয়োজনের সময় নিজের সেঞ্চুরির ব্যাপারে প্রলুব্ধ না হয়ে মুশফিক পিটিয়ে খেলাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের চেয়েও দলীয় স্বার্থ অনেক বড়। ৫০ ওভারে টাইগাররা ৭ উইকেটে ২৭৫ রান করে ইংল্যান্ডের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। বাঁচা-মরার খেলায় ইংলিশরা জেতার জন্য সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করেও জয় পায়নি রুবেল, তাসকিন ও মাশরাফির দৃষ্টিনন্দন বোলিং সাফল্যের কারণে।
কোয়ার্টার ফাইনালেও তারা ১৬ কোটি মানুষের যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবেই নিজেদের উপস্থাপনের চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক সংঘাতে দেশের মানুষ যখন আতঙ্ক ও বিষণ্নতার শিকার তখন ১৬ কোটি মানুষকে আনন্দে পাখা মেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য টাইগারদের অভিনন্দন।
ইংল্যান্ডকে হটিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, তারা আগের মতো নেই। বাংলাদেশকে নিয়ে আইসিসির ভাবা’র সময় এসে গেছে। আমাদের টেস্টের সংখ্যা কম, বিদেশের মাটিতেও খুব বেশি খেলা নাই, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যেও ভাল দল নাই। তাই আইসিসির হয়তো এবারে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতেই পারে।
বাংলাদেশের এ জয়ে আমরা যারপরনাই খুশি। কোয়ার্টার ফাইনালে ভাগ্যে কি আছে তা নিয়ে না ভেবে আসুন আপাতত, সবাই এক পতাকাতলে এসে বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আনন্দে মেতে উঠি।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের জয়ের তিন কাণ্ডারি মাহামুদউল্লাহ রিয়াদ- মুশফিক ও রুবেল হোসেন। মাহামুদউল্লাহ রিয়াদ-মুশফিক জুটি দাঁড়াতে না পারলে বাংলাদেশের স্কোর ২শও পার হতো না। চাপের মুখে তাদের দারুণ পার্টনারশিপে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়তে সক্ষম হয়। তারপরে শেষ দিকে রুবেল যাদুতে কুপোকাৎ হয় ইংল্যান্ড। এছাড়া বাংলাদেশের এখন যে মনোবল, তাতে কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষকে হারানো কঠিন কিছু হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আর ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ এশিয়া কাপ ক্রিকেটে সর্বপ্রথম একদিনের ম্যাচটি খেলে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতে এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। প্রথম বিশ্বকাপেই তারা পাকিস্তান এবং স্কটল্যান্ডকে পরাজিত করে। বাংলাদেশের ক্রিকেট এই অবস্থানে পৌঁছাতে ও নিজস্ব ক্ষেত্র তৈরি করতে কিছু ক্রিকেটারের অবদান অবশ্যই স্মরণযোগ্য।
এই হাস্যোজ্জ্বল দিনে মনে রাখতে হবে ক্রিকেটার ও সংগঠকদের কথাও। এই সাফল্য প্রমাণ করে দলের কোচ, নির্বাচক ও খেলোয়াড়রা নিজস্ব দক্ষতার পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। তাই খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয় ধরে রাখতে হবে। ক্রিকেটের নেতৃত্ব থাকতে হবে যোগ্য লোকদের হাতে। নিজস্ব স্বার্থ নয়, দেশের জন্য সব সময় খেলতে হবে। বর্তমান টিম স্পিরিট ধরে রাখতে পারলে পরবর্তী বছর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য আসতে পারে। আজকের হাস্যোজ্জ্বল অতীত ধরে রাখতে নিষ্ঠা, সাধনা, সততা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে খেলতে হবে প্রতিটি খেলোয়াড়কে। ক্রিকেটারদের এই সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরিচিতিও আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে যাবে সেটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৫