'ঢাকা শহরে আজ একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর সাতকুটরো লাশ পাওয়া গেছে' এবং আকাশ আজ একি রকম নীল ও বাস্তবিক বিকেলের রোদ্দুর তার সোনারঙ নিয়ে গলেগলে শেষ বেলায় মিশে গেছে সোমেশ্বরীতে। সন্ধ্যার বাতাস আজো একই রকম ভাবে বয়ে চলেছে।
বেশিদিন আগের কথা নয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা প্রাঙ্গণে মুক্তমনা সাহসী লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ওপর হওয়া হামলার পর স্বভাবতই চোখ রাখছিলাম সংবাদের আশায় নিউজ চ্যানেলগুলোতে। হঠাৎ দুই তিনটি চ্যানেলে দেখলাম টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে কিছু ছাত্র-ছাত্রী বক্তব্য রাখছেন। তারা ঘটনার সময় আশেপাশেই ছিলেন। কিন্তু ছুটে যেতে পারেননি। কারণ পুলিশি হাঙ্গামায় পড়তে হতে পারে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে, আমি একুশ শতকে বসবাস করছি এবং যারা সাক্ষাৎকারটি দিলেন তারাও, এ শতকেই বাস করেন।
আহমেদ ছফা একবার বলেছিলেন 'আমাদের দেশের বুড়োরা ঠিকঠাক মতো বুড়ো হতেও জানে না। যতোই বুড়ো হয় ততোই তাদের ভেতর বাঁদরের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে। তেমনি অনেক তরুণ কিশোরকে পেন্সিলের একটা খোঁচা দিলেই দেখতে পাই তার ভেতর থেকে অনর্গল বাঁদর-স্বভাবের জীর্ণ বুড়ো বেরিয়ে আসছে। '
আমার কাছে কথাটা সর্বাংশে সত্যি মনে হয়েছে, নইলে -' বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা'- এই মধ্যযুগীয় উচ্চারণ তারা করেন কি করে? আমরা সাবাই জনি অভিজিৎ এর মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা প্রাণপন চিৎকার করেছিলেন সাহায্যের জন্য। কেউ ছুটে যায়নি। পাশে দাঁড়ানো পুলিশ পরে বিবৃতি দিয়েছে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া মনে করে তারা যাননি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ঠিক কতোটা জোরে চিৎকার করলে তবে তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে যে মানুষটির জীবন বিপন্ন? এর আগে সাগর রুনি হত্যামামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালত থেকে সময় নিয়েছেন তিন নয় ২৭ বার নয়, ৩২ বার।
পেট্রোল বোমা, চাপাতি আজ অনেক সহজলভ্য অস্ত্র। ফেসবুক টুইটার ও প্রযুক্তির নানা মাধ্যমে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ বেড়েছে। প্র্রযুক্তির উন্নততর উৎকর্ষ আমাদেরকে নিয়ে চলেছে উন্নততর সভ্যতার কাছাকাছি। আমরা শাহবাগসহ সারাদেশে পেয়েছি চিন্তাশীল প্রতিবাদী এক নতুন প্রজন্ম। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, জাতির সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে গেছে। নইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এ সাক্ষাৎকার দেন কোন মুখে?
স্থানীয় ব্যবসাযী চা-বিক্রেতা ও নানাজনের বক্তব্য শোনা হল, তারাও বললেন পুলিশি হয়রানির ভয়ে তারা এগিয়ে যাননি। কিন্তু বিচিত্র বাস্তবতা হলো, স্বয়ং পুলিশ ইন্সপেক্টর ও তার স্ত্রী খুন হয়েছিলেন কিছুকাল আগে তাদের সন্তান ঐশীর হাতে। আর এইসব ঘটনা প্রমাণ করে শুধু নির্দিষ্ট একটি জনসমষ্টি নয়, জাতি হিসেবেই আমরা সকলে আজ অস্থির, উদ্ধত ও অসহিষ্ণু। আমরা ডাকাত সন্দেহে বারোজন, কিম্বা দশজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারি। রাজনীতির ঝাণ্ডা ওড়াতে রাজপথে চুলোচুলি করতে পারি। কিন্তু পাশেরবাড়ির অসহায় বৃদ্ধার খবর নিই না।
আমাদের সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ আমাদের সহনশীলতা এতটাই কমেছে যে, একই পরিবারে থেকেও আমরা আজ বসবাস করি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। আমাদের ছেলেবেলায় বড়দের মুখে একটা মজার গল্প শুনতাম কলকাতার বাবুদের নিয়ে। যদিও পরবর্তী সময়ে জেনেছি সবকথা সর্বাংশে ঠিক নয়। ভালোমন্দ সদা সর্বএ বিরাজমান। তবে ঐ বয়সে গল্পটা শুনে খুব ধাক্কা লাগতো বুকে। গল্পটা এরকম:
এপার বাঙলা থেকে কোনও একজন ব্যক্তি গিয়ে হাজির হযেছেন পশ্চিমবাংলার এক আত্মীয়ের বাড়ি। যেহেতু দীর্ঘ পথশ্রমে তিনি ক্লান্ত। আশা করছেন উপযুক্ত আতিথ্যের; কিন্তু গৃহকর্তা তাকে সমাদরে ডেকে কুশলাদি জেনে বললেন দাদা পরেরবার কিন্তু অবশ্যই চা খেয়ে যাবেন'- অথবা, আর ও একটি গল্প 'খেয়ে এসেছেন না যেয়ে খাবেন? আমাদের শিশুমনে এসব গল্প ঢুকিয়ে বড়রা নিশ্চয়ই তাদের অজান্তে সাবধান করে দিতেন মানবিক যেন হই, স্বার্থপর নয়।
আমরা প্রতিদিন টিভি পর্দায় অজস্র শিকারী ও নিরীহ শিকার দেখছি। প্রতিটি ভারতীয় শুধু নয়, বাংলাদেশি চ্যানেলেও দারুণ বিষাক্ত সহিংসতা শিখি, আমরা কার্টুনে-গেমসে মানুষ মারার মাধ্যমে, অস্ত্রের মাধ্যমে পয়েন্ট অর্জন শিখি। তার মাধ্যমে সহিংস হতে শিখি। এরপর সংসার, রাজপথ, সমাজ আমাদের জন্য হয়ে ওঠে এক বিগ হান্টিং গেম। এই গেমে আপন স্বার্থসিদ্ধিটাই বড় কথা। কে মারা গেল, মূল্যবোধ কতটুকু রয়ে বা ক্ষয়ে গেল তাতে কারো কিছুই এসে যায় না। সৃজনশীল খেলা বা সমাজ উপযোগী গেমস বা সফটওয়্যার তৈরির কথা কারা ভাবছেন? সবই তো পাশ্চাত্য ধারার আবর্জনা ও ভারতীয় বাজারের একমুখি অনুকরণ। এখানে ক্ষমতাটাই আসল কথা। ছাত্রসমাজ বা সাধারণ সমাজের কিসের এতো দায়? আবার পুলিশি ঝামেলা?
প্রতিটি মানুষ একবর চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন লোককবি কবিয়াল রমেশ শীলের জীবনীতে; যিনি ৭৪ পেরিয়ে ৭৫ এ পড়বার সময় জেলখনায় বসে তার সাথীদের বলেছিলেন, '৪৭ সালের গোলযোগে দেশ ভাঙল, ভেঙ্গে পড়লুম, কিন্তু ৫২ সালের ঢাকার মুসলিম ছাত্ররা গুলি খাইল' আমি সে ঘটনা শুনে মনে মনে বললাম ‘না, আবার দেশ জাগবে। জাগবে। আমার মনে গোস্বা এল। পুলিশ আমার বাড়িতে হানা দিল। আমি পলাতক হলাম। তারপর একদিন গ্রেপ্তার হলাম। প্রথমে জেলে আসতে ভয় হয়েছিল। কিন্তু জেলে এসে যে, আদার-স্নেহ যত্ন পেয়েছি তাতে আমার মনে হযেছে আমি যেন স্বর্গে এসেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি যখন দেওয়ালের এপারে বসে ওপারের শ্লোগান শুনলাম আর পরদিন যখন দলেদলে ছেলেরা-মেয়েরা বন্দী হয়ে আসছে, তখন ভাবলাম ‘না, জীবন মরেনি জীবন আছে'।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা প্রাঙ্গণে আক্রমণের শিকার হন ড. হুমায়ুন আজাদ। তার আগেও প্রগতিশীল ভূমিকার জন্য সহিংসতার শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছেন সাংবদিক মানিক সাহা, পরবর্তী সময়ে ব্লগার রাজীব, সর্বশেষ অভিজিৎ রায়। কর্তব্যরত পুলিশের পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। মনে হয় নিমজ্জিত অন্ধকারে আমাদের বাংলাদেশ। মনে হয় জীবন নেই। আমরা মানবিকতা, সহমর্মিতা হারিয়েছি তখনই দেখি জীবন আছে। আমাদের মাটির ছেলে জীবন। যখন বইমেলা থেকে ফিরবার পথে রিক্শার পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে এক ঘর্মাক্ত তরুণীকে আসতে দেখি। রিকশা থামালে ধুলোমাখা আমারই পড়ে যাওয়া চাদর হাতে তুলে দিয়ে বলে এ্যাই আন্টি কথা শোনে না কেন? আপনার জন্য আমার বয়ফ্রেন্ড দৌড়ায়া মরলো'- তখনও মনে হয় জীবন আছে। কিন্তু সঙ্গে সেই অজ্ঞাতনামা পোড়ামুখের তরুণী এসে বরবার হানা দিয়ে বলে যায় তোমাদের সংবেদনশীলতায় আমার সন্দেহ আছে। এই সমাজের, রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতায় আমার সন্দেহ আছে।
রওশন আরা লীনা,গবেষক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫