সেই মহাঅতীত থেকে জীবন চক্রাকারে অবিরাম গতিতে বয়ে চলছে। সবাই চলছে, চলতে চলতে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে।
এমনিতেই আমরা ওদেরকে গতিশীল চলমান বিশ্বের মানানসই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছি কিনা- প্রশ্ন রয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমাদের নানা দুর্বলতা রয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য জাতি হিসেবে আমরা সংগ্রাম করছি। তার ওপর আবার দিনের পর দিন মাসের পরে মাস ওরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না, লেখাপড়া করতে পারছে না, পরীক্ষা দিতে পারছে না। কি ভোগান্তি, যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রায় পনের লক্ষ এসএসসি পরীক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা শেষ করছে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ জানে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা প্রতিটি মানুষের জীবনে এক একটি বড় মাইলফলক পার হওয়া। আর এসব পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে প্রত্যেকের ভবিষ্যত জীবন। এসব পরীক্ষার সময় প্রত্যেকটি পরীক্ষার্থীর গভীর মনোসংযোগের জন্য মানসিক চাপমুক্ত ও নির্বিঘ্ন শান্তিময় পরিবেশ থাকা একান্ত প্রয়োজন। পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজন, অভিভাবকরাও থাকেন সচেতন। এবার তাদের একটি পরীক্ষাও তারা রুটিনমাফিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দিতে পারেনি। বরং প্রতিটি পরীক্ষার আগে তাদেরকে গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রেডিও-টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। পরীক্ষাটি কাল হবে কিনা? না হলে, কবে হবে? প্রস্তুতি ভেঙ্গে পড়েছে। মানসিকভাবে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য যা থেকে ওদের কষ্ট, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার খানিকটা বোঝা যাবে।
গত ৮ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ১১ তারিখ ভোর ৬টা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ ডাকার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ৮ ও ১০ মার্চের পরীক্ষা দু’টি স্থগিত ঘোষণা করেছিল। ৯ মার্চ বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের সাথে বিজয়ী হওয়ায় হরতাল আহ্বানকারী জোট রাত সোয়া ন’টায় ঘোষণা দিল যে, তারা বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ায় বিজয় মিছিল করবেন। এজন্য ১০ মার্চ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাথে সাথে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিবসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাছে শত শত পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক মহাউৎকণ্ঠায় ফোন করে চলছিল। তাদের সবার প্রশ্ন- হরতাল প্রত্যাহার করায় আগামীকালের পরীক্ষাটি হবে কিনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রচার করেছিল- পরীক্ষা হবে না। এ সিদ্ধান্ত তো আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। যদি পরীক্ষাটি আগামীকাল হয়ে যায়! এটি স্বাভাবিক ভীতি, আশংকা ও উৎকণ্ঠা। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে আমরা কি পাচ্ছি?
রাজনীতি মানুষের জন্য, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কিছু কিছু জরুরি বিষয়কে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখা যায় বৈকি। যেমন- শিক্ষা। ছাত্রছাত্রীরা তো কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর নয়। তারা দলমত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতির সন্তান। তারাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের স্বার্থকে প্রধান্য দিয়ে সকল দলমতের মধ্যে জাতীয় ঐক্যমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিক্ষা আমাদের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির বাইরে থাকুক। তা না পারলেও ন্যূনতমপক্ষে পাবলিক পরীক্ষাগুলোকে হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখা হোক। এসব প্রতিশ্রুতি সবগুলো দল রক্ষা করলে আখেরে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত হতো। আমরা সময়ের সাথে সাথে উন্নত সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হতে পারতাম।
এবারের এসএসসি ও সমমানের তত্ত্বীয় পরীক্ষা ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১০ মার্চে শেষ হবার কথা ছিল। অত্যন্ত দু:খের সাথে বলতে হয়, শুরুর দিন থেকে রুটিনের প্রতিটি দিনে হরতাল-অবরোধ চলছে। পনের লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার দু’টি করে পরীক্ষা দিয়ে চলেছে। এখনো পাঁচ দিনের পরীক্ষা বাকি। তারপর ব্যবহারিক পরীক্ষা। আগামী ১ এপ্রিল থেকে আরো এগার লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবার কথা। ওদের কপালে কি আছে তা ভবিতব্যই জানে। এর আগে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষাকে বিবেচনায় রাখা হতো। এখন আর চিন্তাই করা হয় না।
দেশের সবচেয়ে বড় পরিবার হলো শিক্ষা পরিবার। এর সদস্য সংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটি। অর্থ্যাৎ মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের একভাগ। হরতাল-অবরোধে মুখ থুবড়ে পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থা। বছরের প্রথম দিন হরতালের মধ্যেও নতুন বই পেয়ে উজ্জীবিত ছাত্রছাত্রীরা বইয়ের পাতা খুলতে পারলো না, শিক্ষাপঞ্জি এগিয়ে চলছে লেখাপড়া ছাড়া। প্রচণ্ড ক্ষতি হচ্ছে শিশু-কিশোর ও যুব সমাজের। দিনের পর দিন মাসের পর মাস ছাত্রছাত্রীরা ঘরে বসে আছে। এখন অবশ্য শুক্র ও শনিবারে ক্লাস নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাতে কি ক্ষতি পোষানো যাবে! বিভিন্ন স্থানে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস পরীক্ষা দেয়ার জন্য মানববন্ধন করছে। ১৪ মার্চ দেশের ২১৫৪টি কলেজের বিশ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী মানববন্ধন করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের দেশব্যাপী সবগুলো ব্যানারের ভাষা একই। সেখানে লেখা ছিল- ‘শঙ্কামুক্ত জীবন চাই/ নিরাপদে ক্লাস ও করতে পরীক্ষা দিতে চাই: শিক্ষা ধ্বংসকারী সহিংসতা বন্ধ কর’। এ যেন পথভ্রষ্ট পিতামাতাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সন্তানের আকুল প্রার্থনা। এরপরেও কি আমাদের সবার বোধোদয় ঘটবে না!
জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো শীঘ্রই তাদের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী সবাইকে এখনই পরিকল্পনা করতে হবে কিভাবে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়। সবার সহযোগিতায় আমাদের সন্তানরা আবার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে লেখাপড়া করে চলমান বিশ্বের যোগ্য নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে। সেই হোক আমাদের সবার প্রার্থনা।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫