জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বাধীন কুড়ি দলীয় জোটের প্রধান নেত্রী, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ। গুলশানস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিরানব্বই দিনের স্বেচ্ছা অবরোধ শেষে আপন নিবাস ‘ফিরোজা’য় ফিরে যাবার জন্য এই ধন্যবাদটুকু তার প্রাপ্য।
তবে নারীসহ অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে খালেদা জিয়ার প্রধান পরিচয় তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ রাজনীতিবিদ। একজন রাজনীতিবিদ বিধায় নজীরবিহীনভাবে রাজনৈতিক কার্যালয়ে তিন মাস স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ হয়ে থাকার ঘটনাটার এখন নানামুখী ব্যবচ্ছেদ হবে। আশা করি তার ব্যক্তিগত ও দলীয় মূল্যায়নও হবে সহসা।
একথা অনস্বীকার্য যে, গণআন্দোলনের সাফল্যের প্রধান ভিত্তি জনসমর্থন। জনগণের সমর্থন না থাকলে যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। সঠিক সময়ে সঠিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জনসমর্থন আদায় করতে হয়। এগুলো রাজনীতির মৌলিক পাঠ। বাংলাদেশের মত দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সাধারণত মসৃণ হয় না। তবু সময়োপযোগী দাবির পক্ষে রাজনৈতিক নেতৃত্বে মানুষ সকল প্রতিকূলতা পেরিয়েই আন্দোলনে বিজয়ী হয়। আমাদের গত এক শতকের ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করেই জানুয়ারিতে জামায়াত-বিএনপির আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। তাও আবার ধাপে ধাপে নয়, একেবারে একলাফে সরকার পতনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ, সাথে বোনাস হিসেবে নানা কিসিমের হরতাল। রাজনৈতিক দাবির পক্ষে জনগণকে সম্পৃক্ত করার যে ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা আমরা জানি, অনেকদিন ধরেই জামায়াত-বিএনপি সেই চেনা-জানা পথে হাঁটছে না। জানুয়ারির শুরুতে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘কী এমন হতো যদি সরকার খালেদা জিয়াকে পল্টনের বিএনপি অফিসে যেতে দিত, কিংবা ৫ জানুয়ারি কুড়ি দলকে সমাবেশ করতে দিত’। কী হতো এতদিনে নিশ্চয়ই আমরা তা অনুধাবন করতে পারছি। মূল পরিকল্পনানুযায়ী খালেদা জিয়া পল্টন অফিসে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান নিতেন, আর তার ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল জাতীয় প্রেসক্লাবে আস্তানা গেড়ে মিডিয়ার মাধ্যমে একটা ভজঘট পাকিয়ে ফেলতেন। যদি রাজপথে সমাবেশ করতে দেওয়া হতো, তাহলে পাঁচ মে’র হেফাজতের সমাবেশের মত অবস্থান নিয়ে একটা অরাজকতার সৃষ্টি করা হতো। অর্থাৎ অপ্রচলিত পথে সরকার পতনের লক্ষ্যে একটা বিশৃংখলা তৈরির পায়তারা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। জামায়াত-বিএনপির দুর্ভাগ্য কিংবা সরকারের সৌভাগ্য যে, কুড়ি দলের গোপন কথাটি প্রায়শই আর গোপন থাকে না। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা সরকারের কাছে পৌছে যায়।
স্বভাবতই সরকার তাই জামায়াত-বিএনপির সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। জামায়াত-বিএনপির যে এরকম একটা পরিকল্পনা ছিল, তা পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে স্বেচ্ছা অবরুদ্ধ থাকার মধ্য দিয়েই আমরা দেখতে পেলাম।
বিএনপির আন্দোলনে বর্তমানে লন্ডনের ভূমিকা ব্যাপক। বিএনপির ভবিষ্যত কাণ্ডারি, বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমান দল পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি লন্ডনে বসে রাজনীতির ‘আপোষহীন’ নেত্রী খালেদা জিয়াকে আজকাল অধিকতর আপোষহীনতার পথে ঠেলে দিচ্ছেন। তাদের তথাকথিত আন্দোলনে জনগণের সমর্থন আছে কিনা সেটা মনে হয় তাদের বিবেচনায় ছিল না। বরং পেট্রোল বোমা আর ককটেলের আগুনে গত তিন মাসে দেড় শতাধিক মানুষ পুড়িয়ে জামায়াত-বিএনপি জনগণকে মিত্র নয়, শত্রুর তালিকায় ফেলে দিয়েছিল। জামায়াত-বিএনপি আহুত অবরোধ-হরতালে সাধারণ মানুষের সমর্থন না থাকলেও সর্বত্র মানুষজন ছিল আতঙ্কিত। বাসে-ট্রেনে চড়বার সময় মনে ভয়, এই বুঝি জামায়াত-বিএনপির কেউ পেট্রোল বোমা-ককটেল ছুঁড়ে মারল। লন্ডনে বা গুলশান কার্যালয়ে বসে সাধারণ মানুষের এই আতঙ্কের-আশঙ্কার কথা হয়তো আন্দোলন আহবানকারীরা অনুধাবন করতে পারেনি, তবে আমরা যারা জীবিকার প্রয়োজনে নিয়মিত রাস্তায় বের হতাম, তারা কিন্তু কেউ স্বস্তিতে থাকিনি। সাধারণ মানুষের এই আতঙ্ক-ভয় বিএনপিকে তাদের থেকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছে। সবার মনেই তখন একই জিজ্ঞাসা ছিল, এইভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনসমর্থনবিহীন আন্দোলনের পরিণতি কী? ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি সবসময় বলেছি, বিএনপির এই আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। রাজনীতি এত ছেলেখেলা নয়, তারও নির্ধারিত কিছু ব্যাকরণ আছে। বিএনপি কেন জানি এবার আন্দোলনের কোন সূত্রই মানে নি।
গত বছরের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে তারা ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকে তারা কি আদৌ কোন শিক্ষা নিয়েছিল? নতুবা ব্যর্থ প্রমাণিত পেট্রোল বোমা আর ককটেলের সন্ত্রাসের পথেই কেন আবার জামায়াত-বিএনপি হাঁটল? বিএনপির এবারের আন্দোলনে আমরা অধিকাংশ নেতাদের মাঠে খুঁজে পাইনি, তাদের প্রায় সবাই আত্মগোপণে ছিলেন। চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খালেদা জিয়া নিজে, হয়তো গুলশান কার্যালয়ে থাকা শিমুল বিশ্বাসদের মত অপরিপক্ক লোকজনের পরামর্শ নিয়েছেন! সাথে তো লন্ডন থেকে প্রেরিত ঐশী বানী ছিলই। তবে এইসব গৃহীত কর্মসূচি যে মোটেও সুবিবেচনা প্রসূত ছিল না তা এখন দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। বরং রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে অপরিপক্ক-অকার্যকর-ভ্রান্তসিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি নিজেই নিজেদের ব্যর্থতা নিশ্চিত করেছে।
পরিস্থিতি মূল্যায়নেও সম্ভবত জামায়াত-বিএনপির ভূল ছিল। একাধিক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের পর গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের সময়ে সরকারের অবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল, তখন বিএনপি নির্বাচনে গেলে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল হয়তো তাদের অনুকূলে যেতেও পারত। কিন্তু নির্বাচনের পরের এক বছরে সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তার অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এই এক বছরে দেশে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যাতে সরকার জনরোষের মুখে পড়ে। দেশের এরকম একটা স্থিতিশীল অবস্থায় বিএনপির উচিত ছিল দেশব্যাপী নিজেদের সংগঠনটাকে গুছিয়ে ধীরে ধীরে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা, প্রয়োজনে আগাম নির্বাচনের দাবিও তোলা যেতো। তবে নিজেদের ঘর অগোছালো রেখে, অতিমাত্রায় জামায়াত নির্ভর হয়ে অসময়ে সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দেওয়া যে সঠিক ছিল না বিএনপি নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করতে পারছে।
এত ব্যর্থতার পরও বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সারাদেশব্যাপী শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ছাত্রদলের সেইসব কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই নিশ্চয়ই এখনো বিএনপির সমর্থক বা শুভাকাঙ্খী। বিএনপির কাছে তাদের প্রত্যাশ্যাও অনেক। পাশাপাশি বিএনপির অতিমাত্রায় জামায়াত নির্ভরতা সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের অনেককেই বিব্রত করে। একদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক’ বলে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীপুষ্ঠ জামায়াত নির্ভরতা দলটির স্ববিরোধিতাকে প্রকট করে তোলে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বিএনপি যদি তিন শতাংশ ভোটের অধিকারী জামায়াতকে বর্জন করে, তাহলে কমপক্ষে ছয় শতাংশ অতিরিক্ত ভোট তাদের বাক্সে জমা হবে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় লক্ষ্য করেছি, কেবল জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কারণে অনেকেই বিএনপিকে ভোট দিতে অনিচ্ছুক।
রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করেই মাঠে টিকে থাকতে হয়। ডাইনোসরের মত বিশাল প্রাণীও আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত। বিরাট জাহাজ টাইটানিক তার প্রথম যাত্রায়ই ডুবে যাবে কেউ ভেবেছিল? পৃথিবীর যে দেশের কথাই ধরি না কেন, কোন বৃহৎ রাজনৈতিক দল যদি ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে, তবে দলটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকেই। গত তিন মাসের আন্দোলন শেষে নিঃসন্দেহে বিএনপি এখন ব্যাকফুটে। আমরা তাই আশা করব, বিএনপি তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আপাতত নিজেদের সংগঠন গোছাবে। তারপর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সময়োপযোগী আন্দোলন করবে। তাতে যদি কিছুটা সময় লাগে লাগুক। আন্দোলনের নামে এইভাবে তাড়াহুড়ো করে ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘতর করে লাভ নেই।
যদিও সাম্প্রতিক অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছে, বিএনপি আপন বিনাশী পথে হাঁটতেই অধিক তৎপর।
ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৫
জেডএম/