ঢাকা: জাল ভোট দিলো আওয়ামী লীগ, প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতি করলো তারাই। আর সেই সেন্টারে তিনগুণ বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেন বিএনপির প্রার্থী।
শুনে চমকে গেলেন! আমার চোখের সামনেই এই ঘটনাই ঘটেছিলো বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। আমিও গোলক ধাঁধায় পড়েছিলাম, এও কি সম্ভব! সেই ধোঁয়াশা পরিষ্কার করেছিলেন বরিশাল আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা। তার ব্যাখ্যার সার কথা হচ্ছে, ‘নতুন করে কাউকে নেতা হতে না দেওয়াই এর প্রধান কারণ। ’
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী এলাকা ঘুরে এবং কয়েকদিনের জাতীয় দৈনিকগুলোতে চোখ বুলিয়ে বরিশালের চিত্রই চোখের সামনে ভেসে আসছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পথে যাচ্ছে না-তো?
কেন এ কথা বলছি সে জন্য বরিশালে কি ঘটেছিলো তা জানাতে চাই। বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন পাঠিয়েছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন কভার করতে। দু’দফায় ৯ দিন ছিলাম বরিশালে।
ভোটের দিন (১৫ জুন ২০১৩) দুপুর ১২টায় খবর এলো কাঁশিপুর ভোট সেন্টার দখল করে জাল ভোট দিচ্ছে আওয়ামী লীগের লোকজন। আমি তখন রূপাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট সেন্টারে।
রূপাতলী বরিশাল সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ সীমান্তে আর কাঁশিপুর সেন্টার উত্তর-পশ্চিম সীমা রেখায় অবস্থিত। দূরত্ব সম্ভবত ১২ কিলোমিটারের মতো। একে তো অচেনা পথ থেমে থেমে মানুষকে জিজ্ঞেস করে এগুতো হচ্ছে, অন্যদিকে রাস্তাটি সংস্কারের কাজ চলছিলো, খোয়া ফেলে রাখায় প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যায় কাঁশিপুরে পৌঁছুতে।
ভোট সেন্টার থেকে ১ কিলোমিটার আগেই সাক্ষাত হয় নির্বাচন কভার করতে যাওয়া একজন টিভির সাংবাদিকের সঙ্গে। গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরত যাচ্ছিলেন। মুখোমুখি হতেই মাইক্রোবাসের গ্লাস নামিয়ে আর না এগুনোর পরামর্শ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাবধান করে দিতে ভুললেন না। বললেন, এদিকে যাইয়েন না হামলার শিকার হতে পারেন। জাল ভোট দিচ্ছে হিরণের (আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী) লোকজন।
বলেই দ্রুত গতিতে চলে গেলেন টিভির সেই সাংবাদিক। নিষেধ সত্ত্বেও দ্রুত এগিয়ে যাই। মিনিট দু’য়েক বাইক চালানোর পর ভোট সেন্টারের কাছাকছি যেতেই চোখে পড়ে রাস্তার উপর মানুষের জটলা। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে বলে, একগাদা অভিযোগ তোলেন তারা।
তারা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন সকাল ১০টা থেকে জাল ভোট দিচ্ছে। পুলিশকে বলেও কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ নীরব দাঁড়িয়ে আছে। কোন ভোটার ভোট দিতে পারেনি........।
ভোট কেন্দ্রটি ছিল নারীদের। বাইরে নারীদের লম্বা লাইন। তারা অভিযোগ করেন ২ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।
লাইন ডিঙ্গিয়ে সরাসরি প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে গেলে দরজায় দাঁড়ানো পুলিশ সদস্য জানালেন, প্রিজাইডিং অফিসার ভোট গ্রহণ কক্ষে গেছেন। এগিয়ে ভোট গ্রহণ কক্ষের দরজায় মানুষের জটলা দেখতে পাই।
একজন পুলিশ সদস্য পথ রোধ করে দাঁড়ায়। পরে পরিচয় জানতে পেরে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেন। ভেতরে ঢুকতেই চোখ কপালে ওঠার অবস্থা।
কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার ভোট গ্রহণ কক্ষের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের সামনে দু’টি ছেঁড়া ব্যালট পেপারের মুড়ি বই। ব্যালটগুলো এমনভাবে ছেঁড়া হয়েছে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে দ্রুত ছেঁড়া হয়েছে। ছবি তুলতে ভুল করলাম না।
সেই ছবিসহ নিউজ আপলোড হয়েছিলো বাংলানিউজে। ছবি তোলার পরপরই কক্ষের ভেতরে থাকা পুলিশ অফিসার সক্রিয় হয়ে উঠেন। যারা জাল ভোট দিচ্ছিলেন তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেন। অবসান হয় জাল ভোট প্রদান প্রক্রিয়ার।
আমি নিজে ব্যালট পেপারের ছেঁড়া মুড়ি বই দেখেছিলাম। বাইরে অপেক্ষমান একাধিক ভোটার জানিয়েছিলেন, তারা কেউ কেউ ৩ ঘণ্টা ধরে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত শওকত হোসেন হিরণের লোকজন জাল ভোট দিচ্ছে। তাদেরকে ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না।
জাল ভোট দেওয়া দেখে যা অবাক হয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হয়েছিলাম রাত ১০ টায় যখন কাঁশিপুর সেন্টারের ফলাফল পেলাম।
বিএনপি সমর্থিত আহসান হাবিব কামাল (যিনি বর্তমানে বরিশালের মেয়র) পেয়েছিলেন সাড়ে ১২শ’ ভোট। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত আধুনিক বরিশালের রূপকার প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে ৩শ’ ভোট।
সেন্টারটিতে হিরণের জেতার কথা। তা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখলাম ৪শ’ জাল ভোট দেওয়া হয়েছে। সেগুলো গেলো কোথায়। কেন এমন হল?
এই প্রশ্নের সমাধান দিয়েছিলেন সেই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেছিলেন, ধরেন হিরণ মেয়র হলো তাতে কার বেশি ক্ষতি? উত্তর দিয়েছিলাম কামাল ও বিএনপির। তিনি বললেন, আপনার ধারণা এক হিসেবে ভুল। এখানে রাজনীতির নষ্ট খেলা আছে।
তিনি বলেন, আগে বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরিচালিত হতো আবু হাসনাত আব্দুল্যাহকে কেন্দ্র করে। হিরণ মেয়র হওয়ার পর খর্ব হয়েছে হাসনাতের ক্ষমতা। আবার হিরণ মেয়র হলে নেতৃত্ব চলে যাবে তার হাতে। হাসনাত জিরো হয়ে যাবে।
তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তু করে হাসনাতের লোকজন বিএনপির প্রার্থীকে যদি জাল ভোট দিয়ে থাকলে আমি অবাক হবো না। এটাই হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘দলের চেয়ে আমি বড়’ রাজনীতি বিরাজ করে বড় দু’টি দলে।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ মানে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে এই ধারা বিরাজমান। তার নিজ দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিয়ে মহিউদ্দিন হিরো সেজেছিলেন। তার কাছে পরাজিত হয়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। সেই মহিউদ্দিন এবার আগেভাগেই নিজেকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করে সব ওলোট পালট হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে তার নিজ দলের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আ জ ম নাছিরকে। এরই মধ্যে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন নাছির। আবার যদি মেয়র নির্বাচিত হন তাহলে মহিউদ্দিনের একচ্ছত্র আধিপত্য হ্রাস হতে পারে।
ভাগ বসবে নাছিরের। সেখানে মহিউদ্দিনের পাশাপাশি তার সন্তান চৌধুরী মহিবুল হাসান নওফেল এর ভবিষ্যত জড়িত। অন্যদিকে মনজুর মেয়র হলে দু’দিকেই লাভ। একে তার কথায় চলবে মনজুর। একইসঙ্গে নওফেল এর পথের কাঁটা দূর হবে। আর তার হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকবে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি।
এমন নানা সমীকরণে এখন দুলছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোটের রাজনীতি। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে নিয়ে একই শঙ্কা প্রকাশ করেছে সাঈদ খোকন সমর্থকরা। এখানে ঘরের শত্রুর আঘাতে বিদ্ধ হতে পারে আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৫
এসআই/জেডএম