অতি সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দুইদিনের সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফর শেষ করে গেলেন। দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ২২টি দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি ও প্রটোকল স্বাক্ষর ছাড়াও বহু কাঙ্ক্ষিত স্থলসীমান্ত চুক্তির যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে এ সফরে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কিছু অনন্য নজির স্থাপন করেছেন, নিজের অসাধারণ বাগ্মীতায় মুগ্ধ করেছেন আমাদের।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবেই বাংলাদেশ কি পেলো এই সফর থেকে? কে বেশি লাভবান হয়েছে, বাংলাদেশ নাকি ভারত? এই দুটি প্রশ্নই এখন টক অব দ্য কান্ট্রি।
উত্তর দেওয়া কি এতই সহজ? মোটেই না! দুটি দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রতিটি দেশই 'আপারহ্যান্ড' হতে চায়। তা না পারলে নিদেনপক্ষে 'উইন উইন সিচুয়েশন' তৈরি করতে চায়। যে দেশ যত বেশি বিচক্ষণতা ও চাতুর্য্যের পরিচয় দিতে পারে, সে দেশ তত বেশি লাভবান হয়।
কূটনীতিতে হোমওয়ার্ক ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের কোনো বিকল্প নেই। মিছিল, মিটিং বা রাজপথের আন্দোলনের কোনো মূল্য ডিপ্লোম্যাটিক টেবিলে নেই। এটা দাবা খেলার মতো- যে যত ভালো কৌশল নিয়ে এগুবে এবং কাজে লাগাতে পারবে, তার লাভ তত বেশি। ডিপ্লোম্যাসিতে 'আমি ছোট আমাকে মেরো না' কিংবা 'আমার নাই, আমাকে দেন' এই টাইপ আবেগী কথার কোনো ঠাঁই নেই। উদাহরণ খুঁজতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না। কূটনৈতিক সফলতার জোরেই আমরা মায়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয় করে এনেছি। সমূদ্রের বিশাল এলাকায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। অথচ এর জন্য কোনো মিটিং-মিছিল করা লাগেনি।
২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠাও কিন্তু কূটনৈতিক সফলতার উদাহরণ।
অবশ্য নিজেদের এসব অর্জনের কথা শুনতে অনেকেরই ভালো লাগে না। অনেকেই সমুদ্রের বুকে তালপট্টি খুঁজে বেড়ান। এ কারণেই বিজ্ঞজন বলেছেন, নিজের গরু নিজের ঘাস খেতে চায় না।
মোটাদাগে বলতে গেলে, নরেন্দ্র মোদির সফরকালে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো আমাদের জন্য অনেক প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখন যথাযথ পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে পরিণত করতে হবে। এই কাজে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু আমাদের ভূমিকাও কম নয়।
আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, দ্বিচারী মনোভাব বদলাতে হবে। আপনি এক ঘণ্টা লোডশেডিং হলেই সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করবেন আবার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে গেলে এর বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করে দেবেন, লংমার্চ-শর্টমার্চ করবেন, তা তো হবে না।
মুশফিক ভাই একটা ভালো কথা বলেছেন- ভালো বিস্কুট গাছে ধরে না! এবার আসা যাক বাংলাদেশ- ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জন্য দুটি লক্ষ্য স্থির করেছেন- 'ভিশন ২০২১' ও 'ভিশন ২০৪১'।
অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য-আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তাই, এই দুটি ভিশন আমাদের অগ্রগতির অন্যতম মাইলফলক। ভারতও কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে।
তাদের লক্ষ্য, জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্য পদ লাভ, অর্থনীতিতে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া; সর্বোপরি বিশ্বে পরাশক্তি হওয়া।
ভৌগলিক অবস্থানগত দিক দেখে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছি। তাই, আমাদের যেমন ভারতকে দরকার, ঠিক তেমনি ভারতেরও আমাদেরকে দরকার। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ সেভেন সিস্টারের উন্নয়ন ও অখণ্ডতা রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একইভাবে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভারতের ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখেই ডিপ্লোম্যাটিক স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে আমাদেরকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে হবে।
বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটানের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এ থেকে ভারত যেমন নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেবে, ঠিক তেমনি আমাদেরও সুফল বের করে আনতে হবে। প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে নেপাল ও ভুটানকে যথাক্রমে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
এটা করতে পারলে আমাদের অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে যাবে। সিঙ্গাপুর শুধুমাত্র তাদের সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমেই ‘জেলেপল্লী’ থেকে ‘উন্নতরাষ্ট্র’-এ পরিণত হয়েছে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে না রেখে চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কে কীভাবে উন্নতি করেছে! বিফলে মূল্য ফেরত!
নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যে বলে গেছেন, তিস্তার পানি বণ্টনকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বাস্তবতাটা একটু ভিন্ন। মমতার কাছে তিস্তার পানি বণ্টন এখন রাজনৈতিক ট্র্যাম্পকার্ড। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির অন্যতম হাতিয়ার এটা।
পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা এই ট্র্যাম্পকার্ড খোয়াতে চাইবেন না। এতে আমাদেরও খুব বেশি কিছু করার নেই। অবশ্য নরেন্দ্র মোদি ফিরতি পথে প্লেনে বসেই তার নীতি-নির্ধারকদের তিস্তার পানি চুক্তি বাস্তবায়নে দ্রুত কর্মপন্থা ঠিক করতে বলেছেন, যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরবর্তী ভারত সফরের আগেই এটার একটা কূল-কিনারা হয়। এক্ষেত্রেও আমাদের ডিপ্লোম্যাটিক পথেই এগুতে হবে। পত্রিকায় কলাম লিখে কিংবা রাজপথে হাউকাউ করে সরকারকে দোষী করে লাভ নেই।
সত্য বড় কঠিন। সে কঠিনেরই ভালোবাসিলাম! বিপদে পড়লে বাঘে মোষে একঘাটে জল খায়। আর এখন ওবামা আর কাস্ত্রো এক টেবিলে বসে বিয়ারে চুমুক দিচ্ছেন। এ কথাটা এ কারণে বললাম যে, কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্ধু বা চিরস্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই সুযোগটাই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
আমাদের যেমন ভারতকে দরকার, তেমনি চীন, রাশিয়া, জাপান এমনকি আমেরিকাকেও দরকার। মেরুদণ্ড সোজা রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা চালালে বন্ধুর অভাব হবে না। আমেরিকার কথায় বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মাসেতুর ঋণ বাতিল করেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সব মিথ্যা অভিযোগ অস্বীকার করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর কাজ শুরু করে দিলেন, তখন সেই বিশ্বব্যাংকই নদী শাসনের কাজে ঋণ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। অর্থাৎ নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখা জরুরি।
মাথা উঁচু করেই চলতে হবে যেভাবে চলছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বহির্বিশ্বে আমাদের বন্ধু দরকার, প্রভু না। অতি অবশ্যই পাকিস্তান এ সব হিসাবের বাইরে। শুকরের সঙ্গে সহবাস চলে না! ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশটিতে ১৭ কোটি মানুষ বাস করছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য নেই। নিজের চেষ্টায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি আমরা। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পোর্কন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের সম্ভাবনার খাতগুলো হলো- জনশক্তি, ট্যুরিজম ও বিশাল সমুদ্রসীমা (গভীর সমুদ্র বন্দর)। এই প্রতিটি খাত থেকে সর্বোচ্চ সুফল লাভের জন্য বিশ্বের নানান দেশের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। এটা তখনই সম্ভব, যখন আমাদের সীমান্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপদ থাকবে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। মোদি তার বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের সেই সম্পর্কের পালে বিশ্বাস ও আস্থার হাওয়া জুগিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর থেকে এটাই আমাদের বড় পাওয়া।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ। আমাদের অধিকাংশ অর্জন তার হাত ধরেই এসেছে। শেখ হাসিনার ওপর বিশ্বাস রাখুন। তার সরকারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যেতে দিন। যে উন্নয়নের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের দেখিয়েছেন, সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবেই। শেখ হাসিনার ধমনীতে জাতির পিতার রক্ত প্রবাহমান। এ রক্ত দেশবাসীকে হতাশ করেনি কখনোই। ঊষার আকাশ আজ আগুন রঙে সেজেছে, সূর্য ওঠার বেশি দেরি নেই।
লেখক- সাবেক ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
বাংলাদেশ সময়: ১১১৩ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
এবি