ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দুই মওলানায় ধর্মনিরপেক্ষ আ’লীগ

মনোয়ার রুবেল, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
দুই মওলানায় ধর্মনিরপেক্ষ আ’লীগ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ

আওয়ামী লীগের প্রথম যুগে শেখ মুজিবুর রহমান একক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন না। আওয়ামী লীগ যখন গঠিত হয় তখন শেখ মুজিব যুগ্ম সম্পাদক হন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের মুণ্ডুপাত করে। অজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ইসলাম বিরোধী শক্তি এবং শেখ মুজিবুর রহমান এই ইসলাম বিরোধী তত্ত্বের আবিষ্কারক, তিনি এদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা আমদানি করেছেন।

সত্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগে ধর্ম নিরপেক্ষতা এসেছে দুই জন দেওবন্দ পাস মওলানার হাত ধরে। দেওবন্দ উপমহাদেশের বিখ্যাত মাদ্রাসা। দেওবন্দ আলেমদেরকে খুবই সম্মানের সাথে দেখা হয়।

১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ পরিচালনা করেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানী এই সংগঠনের নাম “আওয়ামী লীগ” প্রস্তাব করেন, তিনিই সভাপতি হন।   ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ।

আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের পর শেখ মুজিবুর রহমান স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।

মওলানা ভাসানী এবং তর্কবাগীশ দুজনেই দেওবন্দের ছাত্র। ১৯০৭ সালে মওলানা ভাসানী দেওবন্দে যান। দুবছর দেওবন্দে অধ্যয়ন করেন। মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দেওবন্দে এবং লাহোরে এশরাতুল ইসলাম কলেজে তর্ক শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন।

এই দুই প্রাজ্ঞ মওলানার হাতে আওয়ামী লীগ বড় হয়েছে, আওয়ামী লীগের মূল নীতি আদর্শগুলো রচিত হয়েছে। যারা আওয়ামী লীগকে ইসলামের শত্রু বলে গালি দেন তারা জানেন না, আওয়ামী লীগ দুই প্রবীণ মওলানার হাতেই সৃষ্ট। বাংলাদেশ আর কোন দল দেওবন্দ পাস কোন মওলানার হাত ধরে গড়ে উঠেনি। যদিও পাকিস্তানের জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী দেওবন্দ আলেম ছিলেন। কিন্তু দেওবন্দের শিক্ষকরা একসময় তাকে ভ্রান্ত বলে আফসোস করেছেন।

আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা জিনিসটি সেক্যুলারিজমের প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্ন। পাকিস্তানে ভিন্ন দুটি ভাষা থাকায় উর্দুশিক্ষিত মোল্লা মুন্সিরা বিভ্রান্ত ছিলেন। সেক্যুলার এর উর্দু প্রতিশব্দ হচ্ছে- “লা দ্বীনিয়াত” অর্থাৎ ধর্মহীনতা; সুতরাং আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজম হচ্ছে ধর্মহীনতা।   কিন্তু আওয়ামী লীগ ধর্মহীনতার কথা কখনো বলেনি। তারা বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। অর্থাৎ যার যার ধর্ম, তার তার।

আওয়ামী লীগের দর্শনে রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে একজন বিচারকের মতো। একজন বিচারক যখন বিচার করেন, হিন্দু মুসলিম দেখে করেন না। বিচারের সময় তিনি একটি নিরপেক্ষ ধর্ম অবস্থানে থাকেন। তেমনি রাষ্ট্র এবং দলের ভূমিকা হবে নাগরিকের ধর্ম বিবেচনা না করে, নিরপেক্ষ। সেক্যুলারিজমের ধারক ও প্রচারক কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের এই সেক্যুলারিজমকে বলে থাকে স্যুডো (ধাঁধা) সেক্যুলারিজম। তারা যেভাবে সেক্যুলার হতে চান আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজম তেমন নয়। আওয়ামী লীগ যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, সেটা ঠিক সেক্যুলারিজমও নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার কোন নির্দিষ্ট ইংরেজি প্রতিশব্দ কার্যত নেই।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ' ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ... মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ..... ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র জিনিস। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। "

১৯৭২ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তিনি বলেছিলেন, এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না।

আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা সেক্যুলারিজমের দৃষ্টিতে একটি নতুন তত্ত্ব। যে তত্ত্ব রাষ্ট্রে সব নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করবে, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের দোহাই তুলতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হবে। আজ ৬৭ বছর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ খুব কম সময়ই তার নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই দীর্ঘ রাজনৈতিক বয়সে ২০০৬ সালে খেলাফত মজলিসের সাথে জোট করার ঘটনাকে একটি কালো ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

আওয়ামী লীগ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে একটি ইসলামী দলের সাথে কিছু ব্লাসফেমি শর্তের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু আখেরে লাভ হয়েছে একটি,  বোখারি শরিফের সফল বাংলা অনুবাদক খ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক তখন প্রত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে বিবৃতি প্রকাশ করে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যদিও সেই চুক্তি বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।

১৯৪৯ সাল থেকে মুসলিম লীগ এবং জামায়াত আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে আসছে। এতে আওয়ামী লীগের ক্ষতি কিছু হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসক জিয়া ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আঘাত হেনেছেন। সামরিক শাসকরা ধর্মের জিকির তুলে কি পাকিস্তান কি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক এই তত্ত্বের উপর আঘাত হেনেছেন বারবার। তাতে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে পিছপা হয়নি।

এই ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদের উপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন সংবিধানের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতা। তখনো ধর্ম গেলো গেলো বলে রব উঠানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু ধর্ম আছে, আওয়ামী লীগও আছে, আছে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদও।

আওয়ামীলীগ কে ৬৭তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

মনোয়ার রুবেল: অনলাইন এক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।