ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ এবং নিঃসঙ্গের সঙ্গীরা

ড. দিলরুবা নাসরিন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৬ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ এবং নিঃসঙ্গের সঙ্গীরা

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে কোথায় যেন আমার আফ্রিকা যাওয়ার সংঘর্ষ হচ্ছে। গত ১৮ জুন ২০১৫ ওয়ান ডেতে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, আর আমি পড়ে আছি কেনিয়ায়।

খেলা দেখা তো দূরের কথা, সারাদিন স্কোর দেখার মত সময় বা সুযোগ কোনটাই পাইনি। সারাদিন কাজ শেষে রাতে হোটেলে ফিরে যখন নিউজ দেখলাম, সারাদিনের সব ক্লান্তি এক নিমিষে দূর হয়ে গেল। এবারো আমি একা! মনে পড়ে গেল ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ার্টার ফাইনালের নিঃসঙ্গ বিষাদময় দিনটির কথা।

২০১৫-এর ৯ মার্চ বাংলাদেশের জন্য উৎসবের দিন। দেশ প্রথমবারের মতো  বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সিদ্ধান্ত নিই—এই খেলা দেখতে হবেই। যেই ভাবা সেই কাজ— আমার আশেপাশে যারা আছেন, এমন সব বাংলাদেশিদের দাওয়াত দেয়া সারা ফেসবুকে।

কিন্তু...বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। জরুরি বার্তা এলো কাজের! ভাবলাম কি, আর হচ্ছেটা কী! ১৯ শে মার্চ যেদিন আমার টিম খেলবে সেদিন আমাকে থাকতে হবে সাব সাহারান আফ্রিকার এক দেশে, যেখানে গত নয় বছরে কোন বাংলাদেশি আমি খুঁজে পাইনি। প্রোগ্রাম পেছানোর প্রচেষ্টা বিফল হলে অবশেষে খোঁজ নিলাম অন্তত খেলা দেখার কোন পথ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। যথারীতি শুনলাম, নো প্রবলেম। আফ্রিকা সবসময়ই নো প্রবলেম এর দেশ। আমার আফ্রিকান সহকর্মী আমাকে সব ধরনের সহযোগিতার পূর্ণ আশ্বাস দেবার পরে যে প্রশ্নটা করলো তাতে খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম, এই ক্রিকেট খেলা কি ফুটবল এর মত পা দিয়ে খেলে?”

বলে রাখি শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার কাজে আমাকে প্রায়ই আফ্রিকা যেতে হয়। কিন্তু, এবার আফ্রিকা যাওয়ার কারণ একটু ভিন্ন। গিয়েছিলাম মালিতে, সাব-সাহারান আফ্রিকার একটি দেশ, যেখানে শিশুমৃত্যুর হার এখনো বিপদজনক পর্যায়ে। স্বাভাবিকভাবে মালি আমাদের গবেষণার অংশ। মালি নিয়ে চিন্তার এই মুহূর্তের কারণ ইবোলা ভাইরাস না। মালিকে সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ গিনিতে ইবোলার আক্রমণ অব্যাহত! গিনি আর মালির মাঝে কোন কাঁটাতারের বেড়াও নেই! মালি নিয়ে  চিন্তার কারণ ভিন্ন। যাওয়ার দিন চারেক আগে আমার ইউনিভার্সিটি (University of Maryland Baltimore)থেকে বিশেষ সতর্কতা সঙ্কেত জানাল! সম্প্রতি মালিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটলেও এর সবই ছিল উত্তরে, টিম বাক্তুর দিকে। কিন্তু আমার সফর শুরুর দুদিন আগে মালির রাজধানী বামাকোতে ঘটে গেছে অচিন্তনীয় জঙ্গি হামলা। যার মূল শিকার ছিল বিদেশি নাগরিকরা। দুজন বিপথগামী মালিয়ান একটা রেস্টুরেন্টে দুইজন বিদেশিসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করেছে, মারাত্মকভাবে আহত করেছে জাতিসংঘে কর্মরত দুইজন সুইস বিশসজ্ঞসহ আরো নয়জনকে। আমার কাজ বামাকোতে— ঘটনাস্থল আর আমার অফিস বলতে গেলে এক পাড়ায়।

মালিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের শাখা আছে (Center for Vaccine Development, Mali) এবং আছে আমাদের নিজস্ব গেস্ট হাউস। আমাদের মালিয়ান গবেষণা সঙ্গী মানুষ হিসেবে অসাধারণ! তার দেশে থাকাকালীন সময়ে প্রতিটি বিষয়ে থাকে তার সুতীক্ষ্ণ নজর— নিরাপত্তা থেকে বিনোদন পর্যন্ত। এবার আমি নজরবন্দির মত। গেস্ট হাউস থেকে অফিস, আর অফিস শেষে গেস্ট হাউস। দুই মিনিটের এই  দুরত্বটুকুও গাড়ি ছাড়া বেরুনোর অনুমতি নেই।

কিন্তু আমার জন্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার কোয়ার্টার ফাইনাল দেখার ব্যবস্থা পাকা। ‘ক্রিকেট পায়ে খেলে কি-না’ জিজ্ঞেস করে আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেললেও গেস্ট হাউসের টিভিতে প্রায় বিশ টির মত স্পোর্টস চ্যানেলের ব্যবস্থা করেছে, যাতে হাতে-পায়ে-মাথায় কোন খেলাই মিস না হয়ে যায়।

গেস্ট হাউসে শুধু আমি আর এর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়নে থাকা ক’জন মহিলা। সবচেয়ে সিনিয়র ভদ্রমহিলা, বয়স আশির মত হবে, তাঁকে আমরা ‘আন্টি মাসা’ বলে ডাকি। তাঁর বিশেষ কোন দায়িত্ব আমার চোখে পড়েনি। অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্বে উলে। বাকি সাত-আটজন উলের কাজের যোগানদার। এখানে যতদিন থাকি, আমার আচরণ হয় বোবার মতো। গেস্ট হাউসের কর্মচারীরা কেউ একটি শব্দও ইংরেজি বলে না। অনেক আগে শেখা ফ্রেঞ্চের অবশিষ্টাংশ দিয়ে কিছু ভাবের আদান প্রদান চালিয়ে নিই। আমি একাই অতিথি, কিন্তু হেঁসেলে পিঁড়ি পেতে ৮ জন মহিলা রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত সেই ভোর রাত থেকে—দুজন কুটনাকোটে, একজন বাটনা বাটে, একজন ধোয়ার কাজে, একজন চুলার ধারে...।

ক্রিকেটে ফিরে আসি। ভোর রাত থেকে  বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে এবং এ খেলা চলবে সকাল ১১টা পর্যন্ত, ততক্ষণ আমি নড়ছি না। কৌতূহলী মালিয়ান সহকর্মীরা জানতে চাইল একা একা এতো লম্বা খেলা দেখতে কি আমার ভাল লাগবে, দু-একজন আমার সাথে খেলা দেখার ইচ্ছাও প্রকাশ করলো।

আমি তাদের নিশ্চিত করলাম, আমি বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সিটি পড়ে যখনি খেলা দেখতে বসি, আমি আর একা থাকি না, সারা বাংলাদেশ থাকে আমার আত্মার সঙ্গে। যখন ঘুমাতে যাবো, আমার মালিয়ান কলিগ কল করে জানালো আনটি মাসাও আমার সঙ্গে খেলা দেখতে চান। একটু অবাক হলাম, আনটি কি করে এই খেলা সম্পর্কে জানেন, যেখানে অন্য সবাই এই খেলা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ!

ভোর রাতে জার্সি পরে, ল্যাপটপ হাতে টিভির সামনে বসলাম, স্কাইপ এ অপর প্রান্তে নেদারল্যান্ডস থেকে আমার হাজব্যান্ড। মাঝে মাঝে আমেরিকা থেকে আমার দুই বাচ্চা জানান দিচ্ছে তারাও খেলা দেখছে। ফজরের নামাজ শেষে আনটি মাসা আসলেন, সোজা আমার পাশে বসে আমার দুই হাত উনার হাতে জড়িয়ে নিয়ে দোয়া ও মোনাজাত করলেন। ভাষা না বুঝলেও এ বুঝলাম— তিনি আমার টিমের জন্য দোয়া করলেন। এরপর তসবি হাতে আমার মুখোমুখি সোফায় গিয়ে বসলেন। খেলা প্রথম থেকে জমে গেছে, চোখ আটকে আছে টিভি পর্দায়। বাংলাদেশ অসাধারণ খেলছে, আমরা চিৎকার করছি, আনন্দে ভাসছি! মাঝে একবার আন্টির দিকে চোখ পড়লো—সে এক দৃশ্য!

আন্টি মাসা খেলা দেখছেন না, উনি আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছেন। আমি যখন হাসছি, উনি নিশ্চিন্ত হয়ে হাসছেন। আমি যখন চিৎকার করছি, উনি চিন্তিত হয়ে ইঙ্গিতে জানতে চাইছেন— কী হলো! বুঝলাম, ক্রিকেট দেখতে উনি বসেননি, বসেছেন আমাকে সঙ্গ দিতে।

খেলার এক পর্যায়ে হতবাক হয়ে দেখলাম— খেলা চুরি হয়ে গেছে। মাঠে আর বাংলাদেশ ইন্ডিয়া খেলছে না, খেলছে আলিম দার আর ইয়ান গোল্ড আর পিছনে খেলছে তাদের বাবা শ্রীনিবাস।

সকাল হতেই উলে আর আমার সহকর্মীর দুই শিশুও ব্যাট (বেসবল) হাতে আমাকে সঙ্গ দিতে এলো। কিন্তু ততক্ষণে রেফারিদের খেলা এতোই কুৎসিত আকার ধারণ করেছে যে, খেলা দেখার আর কোন ইচ্ছা বাকি রইলো না। আমার জিনিসপত্র গুটিয়ে আমি যখন বেরিয়ে যাচ্ছি আন্টির চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন! জানতে চান আমরা জিতেছি কী-না। আমি ইঙ্গিতে বললাম— খেলা এখনো শেষ হয়নি, কিন্তু আমাকে অফিসে যেতে হবে।

অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একই প্রশ্ন— খেলার কী খবর? মন এতোই বিক্ষিপ্ত ছিল যে কারো দিকে তাকাতে পারছি না। ট্রেনিং সেশন শুরু করে দিই। লাঞ্চ টাইমে, আমার মালিয়ান টিম লিডার জিজ্ঞেস করে, তোমার মন কি খুব খারাপ? আমি মাথা নাড়াই। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি খেয়াল করেছ সবাই তোমার টিমকে সমর্থন জানাতে লাল-সবুজ শার্ট পরে এসেছে! এবার ছিল আমার অবাক হওয়ার পালা। সেভাবে হয়তো লাল-সবুজ পোশাক ওদের ছিল না। কিন্তু যার যে কাপড়ে এতটুকু লাল বা সবুজ চিহ্ন ছিল, সে সেই কাপড়টাই পড়ে এসেছে।

আমি অবাক নই লজ্জিতও হলাম! নিজ দলের ব্যথায় এতোটাই কাতর ছিলাম যে, এই ভালোবাসা আমি খেয়ালই করতে পারিনি? আফ্রিকানদের এমন ভালোবাসার উত্তাপে আমার চোখের কোণ ভিজে গেল।

Dr_Dilruba_Nasrin

ড. দিলরুবা নাসরিন: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। পরবর্তী সময় আস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ANU) থেকে epidemiology তে PhD অর্জন করে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ এর ICDDR,B, হয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি (University of Maryland Baltimore) তে গবেষক হিসেবে কর্মরত। ড. নাসরিন Bill & Melinda Gates এর অর্থায়নে গাম্বিয়া, মালি, কেনিয়া, মোজাম্বিক, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণাকাজে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নেদারল্যান্ডসে বসবাস করছেন।

 বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৮ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।