ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলানিউজ ও স্মৃতির ছেঁড়াপাতা

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৫
বাংলানিউজ ও স্মৃতির ছেঁড়াপাতা

ময়মনসিংহ: হিসেব করে চলতে জানি না বলেই বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক হতে পারিনি। যখনই যে টেলিভিশনের দুয়ারে কড়া নেড়েছি, বারবার অদৃশ্য বাঁধা পেয়ে ফিরে এসেছি শূন্য হাতে।

রঙিন স্বপ্নে কালো হাতের কারসাজিতে আবেগ ধাক্কা খেয়েছে। তবুও থামিনি। হতাশার তীর হৃদয়টাকে ছিন্নভিন্ন করতে চাইলেও পরক্ষণেই ভাবতাম, আমি নির্জীব নই। পাথর কেটে কেটে স্রোতস্বিনী ব্রক্ষপুত্রের মতোন ছুটেছি। আশাহত আমাকে আশাবাদী করে তুলতে সাংবাদিক বাবা মো. শামসুল আলম খান সব সময় ঠিক পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন।  

এমন প্রেক্ষাপটে একদিন একটি পত্রিকায় অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের বিজ্ঞাপন ছাপা হলো। দেশের স্বনামধন্য শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়া এটি। নতুন করে আশার ফুল ফুটলো মনের ভেতর। আমি তখন দুখু মিয়ার নামাঙ্কিত কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

আমার আগ্রহ দেখে আব্বা যোগাযোগ করলেন চ্যানেল আই’র সাংবাদিক শেখ মহিউদ্দিন চাচা’র সঙ্গে। আব্বা আর মহিউদ্দিন চাচা হঠাৎ একদিন নিয়ে গেলেন বাংলানিউজ অফিসে। বসুন্ধরা সিটিতে তখন বাংলানিউজ অফিস। অনুমতি সাপেক্ষে হাজির হলাম দেশের অনলাইন নিউজপোর্টালের সফল স্বাপ্নিক পরম শ্রদ্ধাভাজন আলমগীর হোসেনের সামনে দেশে অনলাইন নিউজপোর্টালের পথিকৃৎ, আধুনিক সাংবাদিকতার রূপকারদের একজন। পরিচিত হবার পরপরই আচমকা বললেন, মামুন আজ চারটি নিউজ পাঠিয়েছে।

খুশির ঝিলিক বয়ে গেলো মনে। আবেগে কথা বলতে পারছিলাম না। মাননীয় এডিটর ইন চিফ অভয় দিয়ে ছোট বাক্যে বললেন, কাজ করে যাও।

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসার পর গাড়িতে বসে আনমনে ভাবছি, এবারো না আবার বিষন্ন হতে হয়! তীরে এসে তরী না ডুবে যায়! কিন্তু না। আমার নতুন জীবনের পথচলার প্রারম্ভে পেছনে ঘুরঘুর করা স্থানীয় অদৃশ্য তদ্বিরবাজ সিন্ডিকেট হালে পানি পায়নি। হঠাৎ এক সকালে ফোনে সুখবরটি পেলাম স্বয়ং রুচিস্নিগ্ধ এডিটর ইন চিফের কাছ থেকে।

 ‘মামুন, তোমার অ্যাপয়নমেন্ট লেটার পাঠানো হয়েছে। ’

তৃণমূলের একজন সংবাদ কর্মীর সঙ্গে একজন এডিটর সরাসরি কথা বলেন, এটাই ভাবছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম।

সুখবরটি পেয়েছিলাম শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়েই। গর্বে বুকটা ভরে গেলো মুহূর্তেই। বাঁধভাঙা আনন্দের বারতা মোবাইল ফোনে পৌছে দিলাম আব্বার কাছে। শুরু হলো আমার অনলাইন সাংবাদিকতার পথচলা। কিন্তু তখনো ঠিকমতো বুঝে উঠিনি এ নিউ মিডিয়ার ধরন, ছন্দ এবং কলাকৌশল। সাংবাদিকতার এ পাঠশালায় নিবিড় পরিচর্যায় ক্রমশ বেড়ে উঠতে থাকলাম।

ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট হিসেবে যোগদানের পর কাজ করতে করতেই পুরস্কার পেলাম। আবারো আমার সাংবাদিকতা ভাগ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন একজন মহানুভব সৃষ্টিশীল ও মননশীল মানুষ আলমগীর হোসেন। পদোন্নতি দিয়ে করলেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট। বেতন-ভাতাও আকর্ষণীয়। আমার স্বল্প-দৈর্ঘ্য সাংবাদিকতা জীবনে নতুন অধ্যায়, এক নতুন সাফল্যের ফলক স্পর্শ করা।

দেশের চারটি প্রথম সারির দৈনিকে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল আমার। কিন্তু বাংলানিউজে আমার অনলাইন সাংবাদিকতার যাত্রাপথে স্থানীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা ভাবলেশহীন সংলাপের মধ্যে দিয়ে রীতিমতো হতাশ করতেন।

‘প্রিন্ট ভার্সনেরই খাওয়া নেই, আবার অনলাইন!’ বিদগ্ধদের মুখে নিরাশার বাণী শুনে ভড়কে যেতাম। কিন্তু বাংলানিউজের পেশাদার সাংবাদিকতা চর্চার দিকটি মনে হতেই মুহূর্তেই হুঁশ ফিরতো।  

আমার অনলাইন সাংবাদিকতার শুরুর দিকটা মনের হীরক দ্যুতিতে বার বার জ্বলে উঠছে। রাজনীতি সচেতন জেলা ময়মনসিংহের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী, আমার জীবন ঘনিষ্ঠ রাজনীতিকরাও তখন খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না অনলাইন সাংবাদিকতাকে। তাদের ভাবনা-চিন্তাও যেন ওই বিদগ্ধদের মতোন। আর ইসলামিক চিন্তাধারার রাজনীতিকরা তখন অনলাইন নিউজপেপারের ‘অ’ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
দেশের সবচেয়ে হিট এ অনলাইন নিউজপোর্টালের শুভ জন্মদিনে স্মৃতির সারি সারি চিত্রপট আমাকে বেশ আন্দোলিত করছে। অতীত কাতরতায় আচ্ছন্ন করে। বাংলানিউজে প্রকাশিত আমার বেশ কয়েকটি রিপোর্ট ও পরবর্তী মুহূর্ত কিছুতেই যেন ভোলার নয়। এর মধ্যে একটি নিউজ প্রকাশের পরের ঘটনা পাঠকের সামনে উপস্থাপন না করে পারছি না।

বছর তিনেক আগে খুব সম্ভবত ২ মার্চ ময়মনসিংহ শহরতলী তালতলা মাখযানুল উলুম মাদ্রাসা মাঠে কেন্দ্রীয় সিরাত সম্মেলনের খবর বেশ কৌতূহল নিয়ে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে কভার করতে গিয়েছিলাম। ইত্তেফাকুল ওলামা বৃহত্তর ময়মনসিংহ আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচকের বক্তৃতায় বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের যুগ্ম মহাসচিব ও ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের পুত্র মওলানা মামুনুল হক।

সরকার বিরোধী সমালোচনায় মুখর লাগামহীন ওই বক্তা সেদিনকার বক্তৃতার এক পর্যায়ে মহান জাতীয় সংসদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে বসেন। তার এ বক্তব্যটি শিরোনাম করে বাংলানিউজে পাঠালাম। আপলোড হলো। আসতে শুরু করলো বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ময়মনসিংহ প্রতিনিধিদের অনবরত ফোন।

নিউজটি আপলোড হবার পর প্রায় এক ঘণ্টা আমার অগ্রজ সাংবাদিকদের ফোনে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মুখে পড়লাম। কারণ, তাদের ঢাকা অফিস থেকে সংসদ পোড়ানোর হুমকির নিউজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন সাংবাদিক ওই অনুষ্ঠানে না যাওয়ায় এ নিউজটি মিস করেছেন। পরদিন দৈনিক কালের কণ্ঠ, মানবকণ্ঠসহ দেশের প্রথম শ্রেণীর বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে বাংলানিউজের বরাত দিয়ে নিউজটি প্রকাশিত হলো।

বাংলানিউজে এ নিউজটি আপলোড হবার এক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের যুগ্ম মহাসচিব মওলানা মামুনুল হক জাতীয় সংসদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলেন। বিবৃতি পাঠিয়ে ইত্তেফাকুল ওলামার নেতারা এ বিষয়টি স্পষ্ট করলেন। বক্তব্য দিয়ে প্রত্যাহার করে নেয়ার এ ঘটনাটি আমার সাংবাদিকতা জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।

আমার কাছে সত্যিকারের বীরের প্রতিচ্ছবি মানেই বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। অনেক সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ককেও ছাড়িয়ে যায়। বাংলানিউজে কাজ করতে গিয়ে আমার উর্ধ্বতনদের রাউন্ড দ্যা ক্লক আন্তরিক সহযোগিতা, ভালবাসা ও স্নেহ-মমতায় সিক্ত হয়েছি। হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন ভাই, আউটপুট এডিটর জাকারিয়া মন্ডল ভাইসহ প্রায় সবাই আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। মেনন ভাই আর মন্ডল ভাইয়ের সঙ্গে আমার আত্মার বাঁধন। প্রিয় মন্ডল ভাইয়ের সঙ্গে আমার গভীর হৃদ্যতা, তাই বাংলানিউজে আমি তাকেই জ্বালাতন করি বেশি। মাঝে মধ্যে তিনি বিরক্ত হন, কিন্তু পরক্ষণেই আবার সব ভুলে আশীর্বাদ করেন।

বাংলানিউজের বদান্যতায় আমার পরিচিতি অনেক বেড়েছে। একটি রিপোর্টের সূত্র ধরে একদিন সাদামাটা চালচলনে অভ্যস্ত, প্রথাবিরোধী রাজনীতিক, জনস্বার্থে মন্ত্রিত্বকে নিবেদন করা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহোদয়ের ফোন এলো আমার মুঠোফোনে। হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে ধন্যবাদ জানালেন বাংলানিউজ ও আমাকে। মন্ত্রী, ব্যক্তি বা একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে অনন্য এ মানুষটির এ ফোন পেয়েছি শুধু বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম আমার মতো একজন মফস্বল সংবাদকর্মীর নিউজকে গুরুত্ব দিয়েছে বলেই।

দেশ-বিদেশের কোটি কোটি পাঠক প্রতিদিন বাংলানিউজ পড়েন। এক সময় ময়মনসিংহের তরুণ নক্ষত্র রাজনীতিকরা অনলাইন সাংবাদিকতাকে মনে মনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। এখন তারা বা তাদের অনুসারীরাই বাংলানিউজে আমার নিউজ পড়ে বেশি তালি দেন অথবা গালি দেন। কেউ খুশি হন, আবার কেউ ভীষণ বিরক্ত হন। তাদের দৃষ্টিনিবদ্ধ বাংলানিউজে। তারা এখন অনলাইনে ‘অন’ থাকেন। একই অবস্থা প্রশাসনসহ জেলার সর্বস্তরে। সব জায়গায় এখন বাংলানিউজকে নিয়ে আশাবাদী উচ্চারণ; জয়ধ্বনি।

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, তথ্য নির্ভর বিশ্লেষণ, বিনোদন, শিল্প-সাহিত্য ও ক্রীড়া জগতে নতুন নতুন মাত্রা সংযোজন করে ময়মনসিংহের মানুষের হৃদয় জয় করেছে নিয়েছে বাংলানিউজ। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে এ নিউ মিডিয়া কনসেপ্ট রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। দৃঢ়, বলিষ্ঠ পায়ে বাংলানিউজ আজ ময়মনসিংহে পৌছে গেছে শক্ত ভূমিতে। আমার হৃদয়গ্রোথিত আবেগ আর ভালোবাসার এ প্রতিষ্ঠানের জয়জয়কারে আমি আপ্লুত ও আনন্দিত। সুস্পষ্ট বুঝাই যাচ্ছে এখন সময়টা আর প্রিন্ট ভার্সনের নয়, শুধুই অনলাইনের। আর অনলাইন নিউজপোর্টালের জনকের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের। আমার নিত্য বসবাস বাংলানিউজের সঙ্গেই।
 
লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ময়মনসিংহ
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।