বন্ধুর সাথে ফুলার রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তরুণীটি! ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ হবে; বেশ গরম পড়েছে! প্রকৃতিও হঠাৎ করে তার রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে! জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীত বেশ দুর্বল হয়ে গেছে; সামনেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বসন্ত! বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও কড়া নাড়ছে! ঢাবির এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জরুরি কিছু পরামর্শের জন্য ফুলার রোড পেরিয়ে এস.এম হলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তারা। তরুণীটির ফোন বেজে ওঠে।
“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “তুমি কে,আমি কে-বাঙ্গালি বাঙ্গালি"...
ছেলেটি মন্ত্রমুগ্ধের মত মেয়েটির কথা শুনছিলো। বেশ কিছুক্ষণ আবেগে মিশে একাকার হয়ে যায় ওরা! ছেলেটি মৌনতা ভেঙে বললো, সত্যিই তাই! এপথ ধরেই ছিল তাদের যাওয়া-আসা। এখানে খুঁজলে আজো হয়ত পাওয়া যাবে সেই তারুণ্যের পায়ের চিহ্ন। এখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের গৌরবময় সময়গুলোর দৃঢ়তম প্রতিচ্ছায়া!
কলাভবনের মূল ফটক দিয়ে যখন দু’জনে এগোচ্ছিলো তখন চোখে পড়লো কয়েকজন যুবক বটতলার বাঁধাই করা ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে। ছিমছিমে পাতলা, লম্বা এক যুবক সেখানে বক্তৃতা করছিলো! তরুণী ছেলেটিকে বললো, চল ওদিকটায় যাই। ছেলেটি বললো, ‘তোর না বাড়ন আছে’! খালাম্মা আমাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তুই যেন পড়ালেখার বাইরে কোথায় না যাস। কিছুটা ধমকের সুরে তরুণীটি বললো, তুই একটা ভীতুর ডিম; এত ভয় পাস কেন? চল শুনে আসি কি বলছেন উনি!
তারা দুজনেই একেবারে নিঃসংকোচে বটতলার দিকে এগিয়ে গেল! ভাষণ চলছে, যেন শব্দের আগুনে ফুলকি বেরোচ্ছে! প্রতিবাদসভা হচ্ছিলো সেনাশাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রকে রুদ্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ হচ্ছে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে! সমবেত প্রতিটি তরুণের চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ছিল লক্ষ্যণীয়। প্রিয় নেত্রীকে মুক্ত করে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের একমাত্র ব্রত!
শুরুটা আমার এভাবেই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া; বিলম্ব না করে হলে ওঠা সবই ঘটতে থাকে ধারাবাহিকভাবে! শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের সাথে প্রথম পরিচয়টাও বেশ নাটকীয়; ধারণা করেছিলাম একজন গম্ভীর টাইপ মহিলা হবেন তিনি যার সবকিছুতেই বেশ কঠিন ভাব থাকবে। ধমকের সুরে কথা বলবেন তিনি! তার নাম মমতাজ বেগম, মুখে মায়াবী ডৌল, পোশাকে পরিপাটি; বাণিজ্য অনুষদের ছাত্রী ছিলেন তিনি। দেখা করতে যখন সেমিনারে যাই তখন তিনি পাশেই দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছিলেন, স্বভাবগতভাবেই তার দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল কিন্তু আমার মনে আঁকা ছবির সাথে মিল না থাকায় তিনি যে একজন ছাত্রনেতা সেটা মাথায় আসেনি! ওনাকে খুঁজে না পেয়ে যখন তাকে ফোনকল দিলাম তখনই বেশ ধাক্কাটা খেয়েছিলাম যখন একটু দূর থেকে দেখা ‘তিনিই’ আমার কল রিসিভ করলেন। আরো বেশি অবাক হয়েছিলাম তার সাথে হলে আসার পর; হলের গেটম্যানদের থেকে শুরু করে ক্যান্টিনের বয়দের সাথে তার ব্যবহারের নমনীয়তা দেখে শুধু কি মুগ্ধই হয়েছিলাম! না, সেই সাথে ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা আমার মনে গাঁথা ছিল, সেইদিন তা-ও পাল্টে গিয়েছিল!
৭৫-এর পর যখন বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেওয়াটাও ট্যাবু ছিল, জয়বাংলা যখন রাতারাতি জিন্দাবাদে পরিণ, তখন একদল তরুণ রাতের পর রাত জেগে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে জয়বাংলা ফিরিয়ে আনার মহান কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে জনমত তৈরি করেছিলেন তাঁরা। অনেকবার জেল খেটেছিলেন, ডিটেনশনে বছরের পর বছর অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সেই নতুন দিনের স্বপ্নদেখা তরুণদেরই একজন ছিলেন আমার বাবা। অথচ সেই তিনিই কেন যেন চাননি আমি রাজনীতির সাথে জড়াই!
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই তিনি বলেছিলেন "মা, দেশকে দেওয়ার জন্য অনেক কিছু রয়েছে; নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভালো জায়গায় যাও, যেখান থেকে সমাজ এবং দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করার সুযোগ পাবে! ছাত্ররাজনীতি এখন নষ্ট হয়ে গেছে, এতে জড়িয়ে সময় নষ্ট কোরো না!" কোন উত্তর তখন দিইনি আব্বুকে। শুধু মনে মনে আওড়েছিলাম, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে!’
হলে আমাকে একজনের রুমে ফ্লোরিং করতে বলা হয়েছিল। বেডিংপত্র নিয়ে এসে শুনি আমাকে ওই রুমে থাকতে দেওয়া হবে না। কারণ সেই রুমের বড় আপু ওনার রুমে কোনো উটকো ঝামেলা রাখতে চান না! বিষয়টি মমতাজ আপুকে জানালাম। উনি মেয়েটির সাথে ফোনে কথা বললেন। মেয়েটি আমাকে কিছুক্ষণ পর ডেকে নিয়ে বললেন, ‘দেখো, আমি তোমাকে আমার রুমে রাখতে পারবো না। আমার সিট পারমানেন্ট হয়ে গেছে ;তাই আমি এখন আর ছাত্রলীগ করি না। মমতাজ আপু আমাকে সিট দিয়ে উপকার করেছিল ঠিকই, কিন্তু এখন আমি আর তোমার উপকার করতে পারবো না! তুমি যদি সন্ধ্যার মধ্যে তোমার জিনিসপত্র সরিয়ে না নেও, তাহলে আমি তোমার এগুলো ফেলে দিতে বাধ্য হবো!’ এরপর মনখারাপ করে নামাজরুমে বসে মমতাজ আপুকে আবার ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালাম। কিছুক্ষণ পর অন্য একজন সিনিয়র আপু এসে আমাকে তাদের রুমে নিয়ে গেলেন। ২০৪ নং রুম ছিল সেটা। সেখান থেকেই আমার ছাত্ররাজনীতির শুরু।
ছাত্রলীগের বড় আপুদের অধিকাংশই মাস্টার্স পাশ করে হল ছেড়ে দেওয়ায় আমরা তখন অনেকটা অভিভাবক-শুন্য ছিলাম। আমিই ছিলাম সবার ছোট এবং কার্যত হলে তখন ছাত্রলীগের অ্যাকটিভ কেউ ছিল না। আমি সারাক্ষণ শুধু আপুকে এসএমএস পাঠাই আর বলি, ‘আপু চলেন মিছিলে যাই, আপু চলেন মধুতে যাই’। আপু আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলেন যে, ‘আমি তো হলে থাকতে পারছি না, তুমি জবাকে অ্যাকটিভ করো’! জবা আপু ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। তিনি এক বিল্ডিং থেকে স্লোগান ধরলে আরেক বিল্ডিং থেকে তা শোনা যেত! তাঁর সাথে আমার পরিচয় সাইকেল চালাতে গিয়ে। তাঁকে অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও পারিবারিক কারণে তিনি ছাত্ররাজনীতিতে জড়াতে রাজি হলেন না। কি আর করা! হলের আর এক সাংবাদিক বড়বোন দোদুলের সাথেই মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে ছাত্রনেতা বড় ভাইদের সাথে পরিচিত হলাম। হলে কাজ করতে থাকলাম। মাথায় তখন একটাই চিন্তা- সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, কর্মী বাড়াতে হবে।
‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি সবাই দিতে পারে না। এই স্লোগান দিতে উপলব্ধি থাকতে হয়! যখন দেখলাম এই স্লোগান দিতে অনেকে ইতস্তত করছে, তখন বুঝে নিলাম হলের দায়িত্ব আমাকেই বুঝে নিতে হবে। সংগঠনের প্রতি আমার দায় আর দরদের জায়গাটা বুঝি। জয়বাংলা শুধু আমার মুখের স্লোগানই না,জয়বাংলায় আমি সম্পূর্ণ হই! এই স্লোগান আমরা বংশপরম্পরায় লালন করে আসছি। এই স্লোগানই আমাদের পরম পাওয়া, বিরামহীন ভালোবাসার জায়গা। বাবার সাথে ফোনে কথা হলেই উনি জানতে চাইতেন আমি রাজনীতির সাথে জড়িয়েছি কিনা? শুরুর দিকে কিছুদিন গোপন রেখেছিলাম। পরে ওনাকে বলেছিলাম, ‘আব্বু, আমি গোটা সিস্টেমটাকে বদলাতে হয়তো পারবো না, কিন্তু একটা ইউনিট আমার মত করে গুছাতে পারবো। কিছু ছেলে/মেয়েকে স্বপ্ন দেখাতে পারবো! আমি যেভাবে ভাবি সেই ভাবনা কিছু মানুষের মধ্যে দিয়ে যেতে পারবো। এইটাও কি বড় কিছু না?’ আব্বু তখন চুপ থেকে বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম তুমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারবে না। রক্ত সময়মত কথা বলে। তবে, একটা কথা মনে রাখবে, স্বপ্ন দেখানোর যোগ্যতা সৃষ্টিকর্তা সবাইকে দেয় না। আমি চাই তুমি সেটা অর্জন করো’...। এরপর থেকে পরিবার থেকে আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি। হলের কোনো প্রোগ্রাম হলে আব্বু লুকিয়ে বাড়তি টাকা পাঠিয়েছেন। মা শুনলে খেপে গিয়ে বলতেন, বাপ-বেটি মিলে সংসারের বারোটা বাজাবে। আমরা এক কান দিয়ে শুনতাম আর দু’জন মিলে লুকিয়ে হাসতাম। মা তাতে আরো ক্ষেপে যেতেন।
‘ছাত্রলীগ’ শব্দটি কোনো নিষিদ্ধ শব্দ নয়। ছাত্রলীগের নাম শুনলেই অনেকে একচেটিয়া বিষোদগার করে থাকেন। কিন্তু প্রেক্ষাপটটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাত্রলীগে অনেক ভালো, মেধাবী ছেলেমেয়ে রয়েছেন। অনেক ভালো মনের ছেলেমেয়ের আগমন ঘটেছে এই সংগঠনে; যদিও এদের অনেকেই প্রচারবিমুখ এবং নিভৃতচারী। সংগঠনের জন্য এরা শুধু দিয়েই গেছেন,নিজের জন্য কখনো কিছু প্রত্যাশা করেননি। যত বিশাল সংগঠন তত ভালোমানুষ এবং মেধাবীর সংখ্যাও বেশি এখানে। কিন্তু একটি কথা আছে না: A good news is not a news; it's expected! সাধারণত সারা বিশ্বের দৈনন্দিন খবরগুলোর বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলেও আমরা অপরাধ, বিশৃঙ্খলা, ভায়োলেন্স, যৌনতা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়গুলোই বেশি দেখতে পাই। একারণেই হয়ত ছাত্রলীগের নেতিবাচক খবরগুলোই মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের চোখে বেশি ধরা পড়ে। তবে আমি খুব করে বিশ্বাস করি, যারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, লুটপাট, খুনাখুনি করে ছাত্রলীগের বদনাম করেছে, তারা মূলত ছাত্রলীগ করেন না, তাঁরা সরকারি দল করেন। নাম ভাঙ্গিয়ে সুবিধা নেওয়াই এদের মূল উদ্দ্যেশ্য। ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ফসল। ছাত্রলীগকে চেতনায় ধারণ করা কোনো ছেলেমেয়ে এমন কোনো কাজ করতে পারে না যাতে সংগঠন বিব্রত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান একটি বড় দায় পকেটম্যান বানানো। যখন যে বা যারা শীর্ষ পদটিতে থেকেছেন, তখন তিনি বা তাঁরা কেউই এই প্রক্রিয়ার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। আমার চোখে দেখা খুব কম ছাত্রনেতাই এই প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পেরেছেন। যারা পেরেছেন তারাই লিজেন্ড হয়ে থাকতে পেরেছেন বা পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন বিভাগ,জেলা,থানা,শহর,গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে আসে। উচ্চশিক্ষা নিতে আসা এইসব তরুণ-তরুণীর কাছে পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। এখানে যারা নেতৃত্ব দেন, তারা ভবিষ্যতে জাতীয় নেতা হবেন। সঙ্গত কারণেই তাঁদের নেতৃত্বের ধরনে জাতীয় রাজনীতির শৈলী থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার হীনন্মমন্যতা থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মানসিকতাই অগ্রযাত্রার প্রথম ধাপ বলে গণ্য হবে বা হওয়া উচিত।
খুব সাধারণ উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। ধরুন, আপনি একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের মালিক, যেখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের একটি পদ খালি রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের স্টাফদের সবার স্বাস্থ্যের সার্বিক সুস্থতার কথা বিবেচনা করে একজন ডাক্তারের প্রয়োজন বিধায় একজন ডাক্তারের পদও খালি রয়েছে! সেক্ষেত্রে আপনার নিজের এলাকার কিছু মানুষ সেই পোস্টে চাকুরির জন্য আবেদন করেছেন এবং তারা শুধু ডিপ্লোমাধারী ইঞ্জিনিয়ার এবং ডাক্তারের ক্ষেত্রে প্রার্থী রয়েছেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি পাশ করা ডাক্তার। কিন্তু তাঁরা আপনার পাশের বাড়িতে ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে এবং আপনার খুবই বিশ্বস্ত। এদিকে অনান্য প্রার্থী যারা আছেন তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে উচ্চ ডিগ্রিধারী এবং দক্ষতা সম্পন্ন! এখন প্রশ্ন হলো আপনি কাকে বেছে নেবেন? নিশ্চয়ই যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরাই আপনার পছন্দের হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি আপনার নিজের এবং আপনি অবশ্যই এর ভালো ফলাফল চান। সংগঠনকেও ব্যতিক্রম ভাবার সুযোগ নেই। সংগঠনের ব্যাপারে কেউ যদি দায়িত্বশীল হন তবে তিনি কখনোই অযোগ্য ব্যক্তিদের সামনের সারিতে আনতে পারবেন না।
কিছুদিন আগে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ছেলেটি ঢাকার কোনো একটি কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমরা যখন সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম, ছেলেটি তখন ফোনে কারো সাথে টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছিল। আমি বেশ উৎসুক হয়ে ছেলেটার কথা শুনছিলাম আর কষ্ট পাচ্ছিলাম। কারণ ছেলেটি কোনো এক ভর্তি পরীক্ষায় পরীক্ষার হলে কিভাবে নিদিষ্ট কাউকে সহযোগিতা করবে এবং বিনিময়ে কত টাকা নিবে, সেই কথাই বলছিল। এই রকম ছেলেমেয়ের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও এর দায় থেকে আমাদের কারোরই মুক্তি নেই। এদায় আমাদের সবাইকে নিতে হয়।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি সেক্যুলার ছাত্র সংগঠন এবং এর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই ছাত্রলীগের ইতিহাস’। বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা ইতিহাসের পাশাপাশি ‘বর্তমান’ দর্শনেও বিশ্বাসী। তাই অতীত-ইতিহাস উপস্থাপনের সাথে সাথে ছাত্রলীগ যে ছাত্রদের উন্নয়নে সর্বোপরি সমাজের উন্নয়নে বর্তমানেও কাজ করছে এবং করার মানসিকতায় সংকল্পবদ্ধ, সেটাও তাদের কাছে উপস্থাপন করাটা খুব জরুরি।
জামায়াত-বিএনপি যখন দেশব্যাপী মানুষ পুড়িয়ে মারছিলো, বাংলার আকাশ যখন কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল, চারপাশ যখন পোড়া গন্ধে ভারী, কোমলমতি ছাত্রদের শিক্ষাজীবন যখন বিপন্ন হবার পথে, তখন এই ছাত্রলীগের কর্মীরাই দিনরাত জেগে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো পাহারা দিয়ে আমাদের দৃঢ় সংকল্পের জায়গাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পুন:প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনকে তখন আমরা পাশে পাইনি। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর ছেলেমেয়েদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, তাঁরা মুখে প্রগতির কথা বললেও ভিতরে তাদের সংকীর্ণতার কালো মেঘ জমা। তাঁরা নিজ গণ্ডি থেকে বের হতে পারেন না এবং স্বীয় পরিচিতদের বাইরে মিশতেও পারেন না। সেইজন্যই তাঁদের অবস্থান সাধারণ ছাত্রদের থেকে যোজন যোজন দূরে। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগই একমাত্র ছাত্রসংগঠন যারা সাধারণ ছাত্রদের শেষ আস্থার জায়গাটাতে অবস্থান নেয়।
তারুণ্যের অহংকার সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে 'Clean campus; safe campus' এর স্লোগানে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশকে সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন রাখার যে কর্মশালা গৃহীত হয়েছিল, তা ছিল সময়ের সাথে ছাত্রলীগের যুগপৎ একটি কার্যক্রম, যা চলমান। পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে ছাত্রলীগের এই অভিনব কার্যক্রম নতুন প্রজন্মের কাছে অনন্য এক মাত্রা পেয়েছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নেতৃত্বে চলমান উন্নয়নে সহযোগিতা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমে ছাত্রলীগের সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ায় সুযোগ না থাকলেও, সরকারের এই বৃহৎ উন্নয়ন কার্যক্রমের চিত্র বাংলার জনগণের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপনই হচ্ছে এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মীর দায়িত্ব। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আমাদের সকল অর্জনকে নস্যাৎ করতে যে অপকৌশল এঁটে চলেছে, তাদের সকল প্রোপাগান্ডাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে সত্যকে সামনে নিয়ে আসাই আমাদের কর্তব্য। আমাদের ইতিহাসের সঠিক প্রতিচ্ছবি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে আমরা সরকারকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে পারি। আমাদের নতুন প্রজন্মের মেধা এবং মনন অনেক বেশি সৃষ্টিশীল। আমাদের দেশের আধুনিকায়নে এবং ডিজিটালাইজেশনে ছাত্রলীগই রাখতে পারে মুখ্য ভূমিকা।
আসছে ২৫ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৮ তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নতুন নেতৃত্বে ছাত্রলীগ আরো বেশি সচল হবে, সকল ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে নতুনের জয়গানের মাধ্যমে সকল বৈষম্য এবং অনাচারকে পিছনে ফেলে ছাত্রলীগ দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যাবে--এমন প্রত্যাশাই থাকবে মুজিব-আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রলীগপ্রেমী প্রতিটি মানুষের। আর একটি কথা বলেই অতিদীর্ঘ লেখাটির ইতি টানছি। ছাত্রলীগের সদস্যদের সাংস্কৃতিক চর্চার দিকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে! আমরা এই বিষয়টিতে বেশ দুর্বল রয়ে যাচ্ছি। একটি দেশের ঐতিহ্য তার সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল, যথাযথভাবে এর লালন না করা হলে জাতি হিসেবে মূল জায়গা থেকেই আমরা ছিটকে পড়বো। নারী সহকর্মীদের প্রতি আরো বেশি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সমাজের ট্যাবু ভেঙে মেয়েদের সামনে এগিয়ে নিয়ে আসার যে চলমান প্রক্রিয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সম্পৃক্ত করেছেন, সেই অর্জনের পতাকা ছাত্রলীগকেই উঁচিয়ে ধরতে হবে।
ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে আমার অনেক কিছুই দেওয়ার ছিল। হয়তো আরো অনেক কিছুই দিতে পারতাম আমার প্রিয় সংগঠনটিকে। কিন্তু মনে হয়, কিছুই করতে পারিনি প্রাণের এই ছাত্রলীগের জন্য। আমরা যা পারিনি সেই অপূর্ণতা ছাত্রলীগের আগামীর কাণ্ডারিরা দূর করে দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে আরো শক্তিশালী করবেন, সেই প্রত্যাশাই থাকবে।
বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে। এখন শুধু দিন গোনা। ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো ছাত্রলীগ!
জয়বাংলা || জয় বঙ্গবন্ধু
লেখকঃ সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার