ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

৭১’র অভিশপ্ত শকুন আজ নিঃশেষ প্রায়!

উজ্জ্বল ধর, সিনিয়র ফটো করেসপডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৫
৭১’র অভিশপ্ত শকুন আজ নিঃশেষ প্রায়! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখ। দিনটি ছিল শুক্রবার।

সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশন দলের গাড়ি ছুটছে সার্কিট হাউস থেকে রাউজানের উদ্দেশ্যে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে মোটরসাইকেলে ছুটছি আমিও। সারাদিন কুণ্ডেশ্বরী, জগৎমল্লপাড়া, ঊণসত্তরপাড়ায় ’৭১ এর শহীদ পরিবারের সদস্য আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান শুনছিলেন আর লিখে নিচ্ছিলেন তদন্তকারী দলের সদস্যরা।

অবর্ণনীয় কষ্টের কথা বলছিলেন পিতাহারা, স্বামীহারা, পুত্রহারা নারী-পুরুষ, বয়োবৃদ্ধরা। তবে চোখে মুখে তাদের তখনও আতঙ্ক। একাত্তরের মত আবারো বুঝি তাদের উপর হামলে পড়বে নর পিশাচের দল।

তখনও প্রতিবার ভোটের শেষে এই গ্রামে হানা দিতো সাকা চৌধুরীর নরপিশাচ বাহিনী। কেড়ে নিতো সবকিছু।

সন্ধ্যায় শহরে ফিরে আসি। ফেরার কিছুক্ষণ পর শুনলাম সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলন হবে। ছুটলাম গুডসহিলের উদ্দেশ্যে। সংবাদ সম্মেলনের প্রথমেই যথারীতি ভেংচি কেটে বলে উঠলেন- ‘কি উয়া পিকনিক কেন খাইলা?’ (কি পিকনিক কেমন খেলে?’) ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশন দল তদন্তের জন্য রাউজান ঘুরে আসাকে সেদিন সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, পিকনিক পার্টি, পিকনিক করতে গেছে।

‘কে কি করবে? কি বাল ছিড়বে দেখা যাবে?’ এভাবেই ট্রাইব্যুনালকে কটাক্ষ করে একের এক আজেবাজে শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন তিনি।

এর কিছুদিন পর অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ রাত আটটার দিকে আবার হঠাৎ ক্ষেপে ওঠেন এই রাজাকার। সাংবাদিকদের নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে তাকে ওই রাতে গ্রেফতার করা হবে এমন গুজব ছড়িয়ে সেই বকবকানি, খিস্তি-খেউড়, ‘সাহস থাকলে গ্রেফতার করুক,’ বলে হুমকি।

চট্টগ্রাম সারা দেশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে, এমন হুমকি দিয়ে কিছু পোষ্য কর্মী লাগিয়ে ৭১’র টর্চার সেল গুডস হিলস্থ বাসার সামনে সারারাত মিছিল করান সাকা চৌধুরী।
 
এই সময়ে পোষ্য কর্মীদের একেকজন হঠাৎ ছুটে সংবাদ কমীদের সামনে বললেন, সীতাকুণ্ডে রোড ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে, রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

এই কথা শোনার পর সংবাদকর্মীরা নিজ নিজ সোর্স ব্যবহার করে সে কথার সত্যতা যাচাই করতে শুরু করেন। দেখা গেল পুরোটাই মিথ্যা সংবাদ।

এরই মাঝে সাকার পক্ষের কয়েকজন বিএনপি নেতা গুডস হিলে আসেন। আসেন জামায়াত নেতারাও।

তখনও একই ভঙিমায় ভেংচি কেটে বলেই যাচ্ছিলেন বিভ্রান্তিকর সব কথাবার্তা। একের পর এক সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছিলেন তিনি। গুডসহিলের বাড়ির বারান্দায় এসময়ে তার চেহারায় কিছুটা অসহায়ত্বই ফুটে উঠে।

তবে সেই রাতে আটক হননি সাকা চৌধুরী। ভোররাত অবধি এভাবেই চলল। আর সারা রাত না ঘুমিয়ে পার করলেন সংবাদ কর্মীরা।

সাকা চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হবে কিনা পুলিশের কাছে জানতে চাইলে তাদের কাছে আটক বা গ্রেফতার করার কোন নির্দেশ নেই বলেই জানান সংবাদ কর্মীদের।

এই সময়ে সাকার পোষ্য কর্মী বাহিনী গুডসহিলে থেমে থেমে মিছিল করে। তাদের সংখ্যা জনা বিশেক হবে। এরই মাঝে পরিচিত এক কর্মী একপাশে এগিয়ে এসে কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনি যদি যুদ্ধাপরাধী হন তাহলে বার বার এমপি নির্বাচিত হন কেমনে? তিনি তো তার এলাকায় জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। ’

সেদিন সেই পোষ্য কর্মীকে বলেছিলাম, ‘আপনার নেতা তো সাধারণ ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট না চেয়ে বলতেন, আপনারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন না। না গেলেই আমি বুঝবো আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছেন। আর যারা যাবেন তাদের ওপর ভোটের ফলাফলের পরে আমার রায় কার্যকর হবে। ’

তবে ভোটারের কাছে তার দেওয়া কথা রাখতেন। হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দিতেন, বাড়িছাড়া করতেন, এমনকি ভিটেতে পুকুর কেটে দিতেন। ভিটে জমি দখল করে বাড়ি বাড়ি ডাকাতি করাতেন নিজস্ব বাহিনী দিয়ে। যার ভয়ে রাউজানের অধিকাংশ মানুষ আজ নিজ জন্মভূমি ছেড়ে শহরবাসী। আবার অনেকে দেশান্তরিত। ’
 
যাই হোক, ওভাবেই সেই রাত পার হয়ে যায়। ভোরে যে যার বাড়িতে ফিরেও যায়। এরপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে আত্মগোপণে যান সাকা চৌধুরী। হায় একি কাণ্ড! যাকে আটক করলে চট্টগ্রাম আলাদা করে দেয়া হবে বলে হুমকি-ধমকি সেই তিনিই লুকিয়ে রয়েছেন পুলিশের ভয়ে! যার ভয়ে রাউজানের সাধারণ মানুষ সেই ১৯৭১ সাল থেকে ২০১০ অবধি দিন রাত আতংকে থাকতো তিনি নিজেই লুকিয়ে রইলেন।

দুই তিন দিন আত্মগোপন থাকার পর ঢাকার এক বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হন তিনি। এরপর সারা দেশ থেকে চট্টগ্রামও আলাদাও হলো না। কোথায় হারিয়ে গেল তার আর তার পরিবারের হম্বিতম্বি!

সাকা’র পোষ্য কর্মীদের অত্যাচার বোবা বানিয়ে রেখেছিল হিন্দু আর অসহায় মানুষগুলোকে।

তবে অসহায় ওই মানুষের অভিশাপে সাকার অভিশপ্ত জীবনেও নেমে এলো খাড়া। এখন তার শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার অপেক্ষায় আজ পুরো জাতি।

তার ফাঁসির মধ্য দিয়েই মনের আগুন প্রশমিত হবে রাউজান ফটিকছড়ির অসহায় মানুষগুলোর...।
 
দেশের সর্বোচ্চ আদালতও সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন। আর তাতে আজ থেমে গেছে সব কিছু।

একাত্তরে তার হাতে নিহতদের আত্মা আর তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের ‍অভিশাপে অভিশপ্ত শকুন আজ নিঃশেষ প্রায়।

এখন অপেক্ষায় সারা জাতি ৭১’র ‘কুত্তাটার’ শেষ নিঃশ্বাসের।

.... আজ সময়ের দাবি গুডসহিলকে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করা হোক।

বাংলাদেশ সময় ২১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৫
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।