ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

একটি বিয়ে: আমাদের সামাজিক অসভ্যতা!

মেহেদী হাসান পিয়াস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৫
একটি বিয়ে: আমাদের সামাজিক অসভ্যতা!

ঢাকা: সামাজিকতারও নাকি ভাষা আছে। ভাষার ব্যবহার ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজের পরিচায়ক হয়ে ওঠে।

চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধে অবক্ষয় ঘটলে সামাজিকতার ভাষাতেও অবনতি ঘটে। মানুষের চিন্তা-চেতনা, ভাব, মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে আচার-আচরণ, রুচি-অভ্যাসের মধ্য দিয়ে।

আচার-আচরণও এক ধরনের ভাষা। আচরণ যেমন ব্যক্তির ভাষা, তেমনি আচার হলো সমাজের। ফলে ভাষার ব্যবহারই অনেক সময় সমাজের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়!
 
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামাজিক ‘যোগাযোগ মাধ্যম’ একটি অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে। প্রায় সব সমাজের মানুষই অনুষঙ্গটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণও করেছে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি সময়োপযোগী, ইতিবাচক। কিন্তু সমাজবদ্ধ সবকিছুই যে সামাজিক হবে তা কিন্তু না। সমাজবদ্ধ মানুষই নানা কারণে নানা উপায়ে অসামাজিক!

ইদানিং রুচি-অভ্যাস, আচার-আচরণ, চিন্তা, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে অসামাজিকতার মাত্রা বেড়েছে বা বেড়ে চলেছে। এই বেড়ে চলার কারণ হয়তো অনেক! ব্যাখ্যা বিশ্লষণ করে একে রোধ করা অসম্ভব কিছু না। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিশেষ করে রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসব অসামাজিক কার্যকলাপ ব্যক্তির ভেতরে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ঠাঁই করে নিচ্ছে। ফলে ব্যক্তির ভাষায়, আচরণে, অভিব্যক্তিতে, প্রকাশে সে কখন অসামাজিক হয়ে উঠে টের পাচ্ছে না, আবার অনেকেই তা সচেতনভাবেও করছে। ঘটনার জন্ম দিলে তবেই তা আলোচনায় আসে। আইনের মানদণ্ডে তা অপরাধ বলে প্রমাণ হয়।
 
এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও একটি বিয়ে। সে বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার অবতারণা করতে চাই। সেটা আমাদের সবারই জানা।

কিছুদিন আগে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিতে জাতীয় লজ্জার মতো একটি ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার নাসির হোসেনের পোস্ট করা ভাই-বোনের একটি ছবিতে কুরুচিপূর্ণ এমন সব মন্তব্য করা হয় যা আমাদের জাতীয় লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষোভ প্রকাশ করে নাসির, মাশরাফি নিজেদের ফ্যানপেজও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠে। নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠবে এটাই স্বাভাবিক, এটাই সামাজিকতা।
 
সমাজে এই সামাজিকতা যেমন বিদ্যমান, তেমনি আছেন আপত্তিকর, কুরুচিপূর্ণ ভাষার মন্তব্যকারীরা। তাই ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়ে সামাজিকতা বা অসামাজিকতা নির্ণয় করাটা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কারণ শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নানা আঙ্গিকে, নানা রূপে এসব অসামাজিকতা ছড়িয়ে আছে, লুকিয়ে আছে।
 
এবার বিয়েটির প্রসঙ্গে আসি। শুক্রবার (২৮ আগস্ট) বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেছেন অভিনয়শিল্পী সুমাইয়া শিমু। বর নজরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে শিমুর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিয়েটা পারিবারিকভাবে হয়েছে তা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন শিমু নিজেই।
 
শিল্পী সুমাইয়া শিমু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএসএস করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামাটিকস বিভাগ থেকে পিএইচডি করছেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের মেসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস করেছেন বর নজরুল ইসলাম। মেধা-যোগ্যতায় কে কার চাইতে বেশি বা কম তা বলা কঠিন। হলেই বা কি? দুজনকেই অভিনন্দন, শুভেচ্ছা।
 
অভিনয়শিল্পী হওয়ায় তারকা হিসেবে শিমুকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি, অনেকে হয়তো জানেনও। এখন নজরুল ইসলামকেও আমরা চিনি শিমুর বর হিসেবে। গতকালই (শুক্রবার) ফেসবুকে শিমু-নজরুলের বিয়ের সুন্দর একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কেউ কেউ সে ছবিতে মন্তব্য বা লাইক দেওয়ায় ছবিটি আমার পেজেও আসে। তারকা হওয়ায় শিমুর বিয়ের ছবিটি পরিবার-পরিজন, ভক্ত-অনুরাগী, বন্ধুরা ছড়িয়ে দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না, খেয়াল করে দেখলাম ছবিটি শেয়ার হচ্ছে অন্য একটি কারণেও। কারণটি খুবই জঘণ্য, নিন্দনীয়, লজ্জার এমনকি অপরাধমূলকও!
 
শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানানো তো দূরের কথা, সরাসরি বর্ণবাদি এবং চরম পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণ করা হয়েছে নতুন দম্পতিকে। গায়ের রঙ কালো হওয়ায় বর নজরুল ইসলাম এবং শিমুকে অপত্তিকর, কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করে মন্তব্য করা হয়েছে। মন্তব্যের ধরন দেখে মনে হয়েছে, মন্তব্যকারীদের কেউ কেউ শিমুর বন্ধুও হয়ে থাকবেন! নিন্দা-প্রতিবাদের মুখে যদিও অনেকে মন্তব্য মুছে ফেলেছেন এরই মধ্যে।
 
এসব মন্তব্যকারীদের দৃষ্টিভঙ্গী হলো, শিমু সুন্দর এ কারণে সে যোগ্যতাসম্পন্ন। শিমু লাস্যময়ী, ভোগ্য। অনেকে মন্তব্য করেছেন, টাকা দেখে বিয়ে করেছেন শিমু, তাই তাকে টাকাও অফার করেছেন অনেকে। আর গায়ের রঙ কালো হওয়ায় বর নজরুল ইসলাম কুৎসিত, অযোগ্য, খারাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। টাকাওয়ালা হওয়ার কারণে শিমুর মতো মেয়েকে সে বিয়ে করতে পেরেছে। এসব মন্তব্যের কোনোটাই লিখে প্রকাশ করার মতো না।
 
ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!...। একবিংশ শতাব্দিতে এসে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী লজ্জার, অপমানের। এসব মন্তব্য নারী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও শিমুকে অপমান করা হয়েছে চরমভাবে। শিমুর বরের বেলায়ও তাই। অন্যদিকে এসব মন্তব্য ঘৃণ্য বর্ণবাদি দৃষ্টিভঙ্গী চেতনার যেমন প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি প্রকাশ ঘটেছে চরম পুরুষতান্ত্রিক লাম্পট্যের।
 
যারা সচেতন বা অসচেতনভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গী লালন করেন তাদের প্রতি নিন্দা-প্রতিবাদ জানানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। এসব মন্তব্য দেখে চুপ করে থাকা বা নির্লিপ্ত থাকাটাও এক ধরনের অশ্লীলতা।
 
কি দেখে, কি কারণে নজরুল ইসলামকে বিয়ে করেছেন শিমু সেটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। বাড়িয়ে বললে, তার পরিবারের বিষয়। যে কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার অধিকার শিমু বা নজরুলের যেমন আছে তেমনি আছে অশ্লীল মন্তব্যকারীদেরও।
 
এবার ফিরে আসি আগের কথায়। এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষাকে আশ্রয় করে যে অসভ্যতা ফুটে উঠেছে, তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একে রোধ করার দায়িত্ব ব্যক্তি, পরিবার,  সমাজ, প্রশাসন, রাষ্ট্রের।
 
সামাজিকতা-অসামাজিকতা দু’টোই সহাবস্থান করছে সমাজবদ্ধ ব্যক্তি, চক্র, গোষ্ঠীর মাঝে। ভাল-মন্দ, সামাজিকতা-অসামাজিকতার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। নিরন্তর দ্বন্দ্বের ফলেই এগিয়ে যায় সমাজ-সভ্যতা। এই এগিয়ে যাওয়াটা এমনি এমনি ঘটে না। সমষ্টিক সচেতন প্রয়াসে এগিয়ে নিতে হয়। আর সেটা একমাত্র সমাজবদ্ধ মানুষের পক্ষেই সম্ভব। জীব জগতের অন্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য এখানেই।
 
সেই সচেতন প্রয়াসে এমন জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তা, কর্মকাণ্ডকে অসামাজিক বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। অসামাজিক শব্দটার মাঝে এক ধরনের প্রশ্রয় আছে! এগুলো সামাজিক অসভ্যতা। একে নির্মূল সম্ভব কিনা জানি না, তবে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায় নেই।

সবশেষে লজ্জা, দুঃখ প্রকাশ করে বলতে চাই, ছদ্মবেশী এসব অসভ্য বন্ধু-স্বজন কেবল আপনার- আমার নয়, আমাদের সবার লজ্জার কারণ। আপনাদের (শিমু-নজরুল) দাম্পত্য জীবন সুখের হোক। শুভকামনা রইলো...।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৫
এমএইচপি/ জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।