ঢাকা: শোকের মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। শোককে কতোটুকু শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছি, সেটাই আসল বিষয়।
এখন সবকিছুই যেন বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিয়েছে। আমরা যতোটা আনুষ্ঠানিক, ততোটা আন্তরিক নই। আবার যতোটা আন্তরিক, ততোটা কর্মঠ নই।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না। আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না। যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না। ’
এখানেই আমাদের সমস্যা। এ সমস্যার উত্তরণ না হলে সত্যিকারের সোনার বাংলা আজীবন অধরাই রয়ে যাবে।
বাস্তবতার নিরিখে জীবন-মরণ এবং পরবর্তী পরিস্থিতির বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা বিষয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এক অভিভাষণে তিনি বলেছেন, ‘যেদিন আমি চলে যাবো-সেদিন হয়তো বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরুবে আমার নামে! দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে, বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটা কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা-পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি। ’
আমাদের ব্যর্থতা আরও স্পষ্ট হয় আমরা যখন বক্তৃতা-সেমিনার করে কণ্ঠে তুমুল আওয়াজ তুলি। কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ করি না। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে আমরা কতোজনই বা বলতে পারি-‘বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি। ’
সেই মানুষটিকে অনেক বিশেষণেই বিশেষায়িত করা যায়। সেসব বিশেষণে যাচ্ছি না। শুধু বলতে চাই, তিনি একজন কবি। রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তিনি এক মহাকাব্যের জন্ম দিয়েছেন। তিনি তাৎক্ষণিক সৃষ্ট ১৮ মিনিটের বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক কবিতা লাখো বাঙালিকে শুনিয়েছিলেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে চিরভাস্বর।
সেই কবিতা প্রসঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় লিখেছেন-
‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে
কখন আসবে কবি?’
এই কবিই দিশেহারা বাঙালি জাতির মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য জীবন-যৌবনের মূল্যবান সময় তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের আশঙ্কা জেনেও তিনি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসা ত্যাগ করেননি। পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাংবাদিক মিস্টার ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুই শ্রেয়, তবু আমার জনগণ বেঁচে থাকুক। তারা আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। ’
একাত্তরে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে কারাবন্দি শেখ মুজিবকে ভয় দেখানোর জন্য, তাদের সঙ্গে আঁতাতে বাধ্য করার জন্য কারাগারের পাশে তার চোখের সামনে তারই কবর খোঁড়া হচ্ছিলো।
এতে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হননি। বরং তিনি তার সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন। জীবনের পরতে পরতে তিনি সংগ্রাম ও সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন।
মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। ’
তিনি সেই মানুষ যিনি ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রত্ব হারান। তার সহপাঠীরা পরবর্তীতে ভুল স্বীকার করে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে আনলেও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তরুণ শেখ মুজিব তা করেননি।
পাঁচ বর্ণের ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি কবিতা সৃষ্টির জন্যই ছিল তার অমৃত্যু সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের স্বপ্নসারথি আমরা এখন কোথায় আছি! যাচ্ছি কোথায়!
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৫
টিআই/আরএম/এএসআর