ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চাই আরও কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১১
চাই আরও কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন

এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের (৩১ মে) প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘এফসিটিসি’ (ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল)।   বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক এ আন্তর্জাতিক চুক্তিটি প্রণীত হয় এবং ২০০৫ সাল থেকে তা কার্যকর হয়।

  বর্তমানে বিশ্বের ১৭৩টি দেশ এফসিটিসির পক্ষভুক্ত।   বাংলাদেশ এ চুক্তিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ।

এফসিটিসির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫’ প্রণীত হয়।   এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার একটি প্রধানতম অর্জন।   এ আইনে এফসিটিসির অনেকগুলো শর্ত যদিও পুরোপুরি বা আংশিকভাবে পালিত হয়েছে, তারপরও এর মধ্যে রয়েছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা। ফলে এ আইনটির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যকরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।   এ বাস্তবতায় বর্তমান আইনটিকে এফসিটিসির আলোকে সংশোধন করে অধিকতর কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কোন কোন দিক থেকে আইনটিকে উন্নত করার প্রয়োজন, সে ব্যাপারে কিছু সুপারিশ :

ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যগুলিও তামাক
বর্তমান আইনের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খৈনিসহ ধোঁয়াবিহীন তামাককে তামাকপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।   ফলে এসব পণ্যের ক্ষেত্রে আইনগত কোনো পদক্ষেপই প্রযোজ্য হচ্ছে না।   অথচ এসব ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের ব্যবহারের হার বর্তমানে বাংলাদেশে ধোঁয়াযুক্ত তামাক যেমন সিগারেট ও বিড়ির চেয়ে বেশি।   প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে ২৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করছেন, অন্যদিকে ধূমপায়ীর হার ২৩ শতাংশ।   এফসিটিসিতেও তামাকপাতা থেকে তৈরি সব ধরনের পণ্যকেই ‘তামাকপণ্য’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।   তাই জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খৈনিসহ সব ধরনের ধোঁয়াবিহীন তামাককেই ‘তামাকপণ্য’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে বর্তমান আইনের সংশোধন করতে হবে।

শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ চাই
অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপান থেকে রক্ষা করার জন্য এফসিটিসি শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছে।   বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে জনসমাগমস্থল (পাবলিক প্লেস) ও জনপরিবহন (পাবলিক ট্রান্সপোর্ট) ধূমপানমুক্ত।   তবে ‘পাবলিক প্লেস’-এর সংজ্ঞায় সব ধরনের স্থান অন্তর্ভুক্ত হয়নি।   এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ ও কর্মক্ষেত্র, যদিও এসব স্থানেই সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।   একই ভাগে ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্ট’-এর মধ্যে অযান্ত্রিক যানবাহনের কথা বলা হয়নি।  

এসব বিবেচনায়, বর্তমান আইনটিকে সংশোধন করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের আওতা বাড়ানো প্রয়োজন।   তাছাড়া ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বা স্মোকিং জোনের বিধান রাখাও এফসিটিসির সুস্পষ্ট লংঘন।   এর ফলে ‘ধূমপানমুক্ত’ স্থানগুলোতেও অধূমপায়ীরা পরোক্ষ ধূমপান থেকে সুরক্ষা পাচ্ছেন না।   তাই স্মোকিং জোন রাখার এ বিধানটিও আইন থেকে তুলে দিতে হবে।

তামাকপণ্যের প্রচারণা বন্ধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি
তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা আইনত দ-নীয়।   তবে আইনের কিছু ফাঁকফোকর রয়েছে, যা ব্যবহার করে তামাক কোম্পানিগুলো তামাকপণ্যের প্রচারণা ব্যাপকভাবে অব্যাহত রেখেছে।   বিজ্ঞাপন বন্ধের বিধান তামাকপণ্যের বিক্রয়স্থলগুলোতে প্রযোজ্য নয়।   তাই তামাকপণ্যের অসংখ্য দোকানে যত্রতত্র চোখে পড়ে প্রচুর বিজ্ঞাপন।   ফলে গণমাধ্যমে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধের সুবিধা অনেকটাই পাওয়া যাচ্ছে না।   এছাড়া আইনের দুর্বলতার সুযোগে পরোক্ষ বিজ্ঞাপন চলছে হরদম।   চলছে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা।   এসব প্রচারণাকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁক-ফোকরগুলি বন্ধ করে আইনটিকে সংশোধন করতে হবে।   এফসিটিসির শর্ত অনুসারে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী সংযুক্ত করতে হবে
বাংলাদেশের তামাকপণ্যের মোড়কে আইন-অনুসারে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বিদ্যমান।   তবে দেশের মানুষের বড় অংশই যেখানে নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত, সেখানে এসব লিখিত সতর্কবাণী অধিকাংশ মানুষের কাছেই কোনো অর্থ বহন করে না।   তাই এসব মানুষের জন্য চাই ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী।   তামাকপণ্যের মোড়কের অন্তত অর্ধেক জায়গাজুড়ে এসব ছবিতে থাকবে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগের বীভৎস ছবি।   তাহলেই এসব সতর্কবাণী তামাকসেবীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করবে।   এফসিটিসির পরামর্শ অনুসারে পৃথিবীর ৪৩টি দেশে ইতিমধ্যেই তামাকপণ্যের মোড়কে ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী চালু হয়েছে।   বাংলাদেশেও এটি করা দরকার।

তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবে না
তামাকপণ্যের মধ্যে কোনো নিরাপদ বা কম ক্ষতিকর পণ্য নেই।   সব ধরনের তামাকপণ্যই স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি ও মৃত্যুর কারণ।   অথচ তামাক কোম্পানিগুলোর সুচতুর প্রচারণায় তামাকসেবীরা বিভ্রান্ত হয়ে তামাক ছাড়ার পরিবর্তে বিভিন্ন তথাকথিত ‘কম ক্ষতিকর’ তামাকপণ্য সেবন করছেন।   তামাকপণ্যের মোড়কে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বিশেষণ যেমন ‘লাইট’, ‘লো টার’, ‘আল্ট্রা লাইট’, ‘মাইল্ড’ ইত্যাদি শব্দ বা ক্ষতির মাত্রা নির্দেশক বিভিন্ন রঙের ব্যবহার এফসিটিসি অনুসারে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।   পৃথিবীর অন্তত ৫০টি দেশে এসবের ব্যবহার ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।   অথচ বাংলাদেশে এর ব্যাপক ব্যবহার চলছে।   তাই এসব বিভ্রান্তিমূলক কৌশল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে বর্তমান আইনের সংশোধন করতে হবে।

অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তামাক নয়
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোনো মানুষই শিশু হিসেবে বিবেচিত।   এসব শিশুর কাছে কিংবা এদের মাধ্যমে তামাকের ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করতে এফসিটিসির স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।   সে অনুসারে বাংলাদেশেও ১৮ বছরের কম বয়সী কারো কাছে বা এমন কারো মাধ্যমে তামাকের ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।

জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে
বাংলাদেশের বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বিভিন্ন বিধান লংঘনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হারে জরিমানা করার ব্যবস্থা রয়েছে।   তবে এসব জরিমানার পরিমাণ নিতান্তই অপ্রতুল এবং আইন লংঘন থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট নয়।   তাই এসব জরিমানার পরিমাণ অনেক গুণ বাড়াতে হবে।   পাবলিক প্লেস ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপানের জন্য জরিমানা ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করতে হবে।   তামাক কোম্পানি কর্তৃক আইন লংঘনের জন্য জরিমানার পরিমান ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত করতে হবে আর তা অনাদায়ে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান করতে হবে।

আইনের প্রয়োগ সহজতর করতে হবে
বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ সহজ নয়।   একে আরো প্রয়োগবান্ধব করতে হবে।   পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের কর্তৃপক্ষকে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দিতে হবে।   পুলিশ বাহিনীকে এ আইনের প্রয়োগে সম্পৃক্ত করতে হবে।   আর যে কোনো ব্যক্তিকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।   তাহলেই আইনের কার্যকর প্রয়োগ সম্ভব হবে।

তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করা এবং তামাকের ওপর কর বৃদ্ধি জরুরি
তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করার জন্য কৃষকদের বিকল্প ফসল চাষের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং তামাকপণ্যের কর অব্যাহতভাবে বাড়ানোর মাধ্যমে সব ধরনের তামাকপণ্যের উত্তরোত্তর মূল্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে সফলভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

বিভিন্ন গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে এই সুপারিশমালা তৈরি করেছে : ‘ব্লুমবার্গ গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু রিডিউজ টোব্যাকো ইউজ’ এবং ‘ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রি কিডস’

বাংলাদেশ সময় ১৬৫০ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।