ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ও টেকসই উন্নয়ন ভাবনা

পলিন কুমার সাহা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ও টেকসই উন্নয়ন ভাবনা

বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ও প্লাবন ভূমি, যেখানে বেশির ভাগ অর্থনীতি অভ্যন্তরীণ নদী ও সমুদ্র শাসনে প্রভাবিত হয়। প্রতিবছরের বন্যায় এই নদীগুলো আমাদের বিস্তর ভূমিকে উর্বর করে, যা আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে বেশ ভালোভাবে ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু এর পাশাপাশি প্রতিবছর বাংলাদেশকে তার দুর্বল পানি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোর দিক থেকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- প্রতিবছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, লবনাক্ততার অনুপ্রবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আরও অনেক ইস্যু মানুষের জীবন-জীবিকাকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে।

জলবায়ু পরিবর্তন এ সময়ে খুবই একটি আলোচিত বিষয়, যার প্রভাবের ফলাফল আমরা এখন তিক্ততা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগ করছি। আর এই কারণেই বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা (A Bangladesh Delta Plan)। এর একটা উল্লেখযোগ্য পটভূমি হচ্ছে sea level rise তথা সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও আমাদের টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা। আমরা যদি জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে চাই, তাহলে বাংলাদেশের ডেল্টা প্লান’র উদ্যোগকে এখন থেকেই সফলভাবে পরিচালিত করতে হবে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডস সফর করেছেন। এই সফরে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে বড় একটি বিষয় হচ্ছে- বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান পরিকল্পনা ও তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা এবং আমরা কীভাবে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে এ রকম একটি বড় প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করে যেতে পারি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া প্রকল্পটি হলো ‘ Towards a Bangladesh Delta Plan’। এই প্রকল্পের ফলাফল রচিত হবে ৫০ থেকে ১০০ বছরের একটি সমন্বিত এবং টেকসই পরিকল্পনার কাজের উপর ভিত্তি করে। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য, আমাদের নিরাপদ জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা এবং দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা। এ বিষয়ে অবশ্য ২০১২ সালেই বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

আমরা বিশ্বাসী যে নেদারল্যান্ডস বিশেষজ্ঞ দল বেশ ভালভাবেই এ ধরনের কাজে দক্ষ। তাছাড়া, পানি বাবস্থাপনায় নেদারল্যান্ডসের প্রযুক্তি ইতোমধ্যে বিশ্বজোড়া অনন্য এক স্বীকৃতি পেয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান থেকে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস দুই দেশই উপকূলবর্তী ও বন্যাপ্রবণ। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, পানি অব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশে প্রতিবছর অনিয়ন্ত্রিত বন্যা হয়। আর নেদারল্যান্ডস এ ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে বন্যা থেকে সুরক্ষিত থাকে। একইসঙ্গে ডাচরা নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহও করে থাকে দারুণভাবে।

নেদারল্যান্ডস সরকার ১৯৫৩ সাল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ডেল্টা প্লানকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমরা এখনও তাদের অনেক পেছনে। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রায় ৬০ বছর পরে এসেও ডাচরা দেখছে তাদের ডেল্টা প্লান মূলত টেকসই উন্নয়নের একটি উদ্যোগ মাত্র, কিন্তু তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি এখনও। কারণ হিসেবে তারা প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছে। তারা বলছে, তাদের এই টেকসই পরিকল্পনার উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরেও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অতি বৃষ্টি ও তাপমাত্রার বৃদ্ধির পরিবর্তন তাদের সফল কার্যক্রমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

তাই এসব সমস্যা এখন আমলে নিয়ে ডাচরা তাদের ডেল্টা প্লানকে নতুনভাবে সাজানোর চিন্তা করছে। এই বিষয়ে ডাচ ডেল্টা কমিশন আটটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে। বিষয়গুলো হলো- পানি, বসত, কাজ ও নিয়োগ, চিত্ত বিনোদন, কৃষি, প্রকৃতি, অবকাঠামো (গণপূর্ত) এবং স্থানিক (Spatial) পরিকল্পনা। তবে সবকিছুর মূলে ডাচ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য দু’টি- ১) বন্যা নিয়ন্ত্রিত দেশ এবং ২) নাগরিকদের পর্যাপ্ত সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা।

এখন নজর দেওয়া যাক বাংলাদেশ ডেল্টা প্লানের দিকে। কতটুকু টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আমরা এই পরিকল্পনা হাতে নিতে পেরেছি? এক কথায় বলা যায়- টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমাদের ডেল্টা প্লানকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে সমন্বিত করা প্রয়োজন। এখনকার ডেল্টা পরিকল্পনায় প্রধানত নদী শাসন ও খাদ্য নিরাপত্তাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবসম্মত টেকসই উন্নয়নের মূলনীতি বিশ্লেষণ করলে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেও এই প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে। তবে এই প্রকল্পের একটা ভাল দিক, বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান সরকারি এবং বেসরকারি অনেক সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নজর দিতে হবে, উদ্দেশ্য যেন সবার সমান হয়। সম্ভাব্য সকল সাধারণ সুবিধাভোগীদের এই প্রকল্পের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো টেকসই উন্নয়নের একটা অন্যতম ধারাবাহিকতা। কিন্তু কেবল নদী খনন আর বন্দর উন্নয়ন করলে এই ডেল্টা প্লানের মূল কাজে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। আমাদেরকে আরও সমন্বয় করতে হবে। আর এটা নেদারল্যান্ডস এবং বাংলাদেশের মধ্যেকার বিভিন্ন শ্রেণির স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম থেকে হতে পারে।

বিভিন্ন তুলনামূলক বিশ্লেষণে আমাদের টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় নিম্নলিখিত ধাপগুলো একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হতে পারে, যেখানে আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয়ে সমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়। ধাপগুলো হলো- ১) একটি পদ্ধতিগত উন্নয়ন, যেখানে বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান এবং এর সমস্ত সম্ভাব্য দিকগুলোর সঙ্গে আমাদের জীববৈচিত্র্যের একটি সম্পর্ক ও স্থিতিস্থাপকতা বিশ্লেষণ। ২) ডেল্টা প্লানের উদ্দেশ্যকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা, যা কিনা আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। যেমন, এক্ষেত্রে ডাচ কমিশনের ওই আটটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করে সফলতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা। ৩) কৌশলগত ধাপগুলো নিশ্চিত করা এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলোকে একটি নীতির ফ্রেমে আর্থিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সম্পদ রক্ষা প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে এগোনো। এক্ষেত্রে নমনীয় (flexible) কাজের পরিবেশ এবং বিনিয়োগের উপর যথেষ্ট রিটার্ন নিশ্চিত করে কৌশল ঠিক করা। ৪) কৌশলগত অবলম্বনে ডেল্টা প্লান প্রকল্পের কাজগুলোকে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে কর্ম পরিকল্পনা করা, ৫) কিছু পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন সংক্রান্ত সারঞ্জাম তৈরি কর‍া, যা পুরো বিষয়গুলোকে ধাপে ধাপে মূল্যায়ন করার জন্য সক্ষম। এখানে টেকসই উন্নয়ন এর সূচক, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং “life cycle evaluation” অন্তর্ভূক্ত থাকবে।

সর্বশেষ বলতে হয়, আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ নেদারল্যান্ডস সরকারের আন্তরিক সহযোগিতায় ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের কাজ সফলভাবে এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আলোচনায় আমাদের, তথা আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরবেন বিশ্বের কাছে - এই প্রত্যাশায়।

লেখক
পলিন কুমার সাহা
গবেষক, ব্র্যাক গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ
[email protected]; [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।