মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি বিশেষ বিষয় আপনার কাছে পেশ করতে চাই। আর তা হচ্ছে- যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হোক।
কারন ফজলুল কাদের ফকা চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই বন্দি অবস্থায় কারাগারে মারা গিয়েছিলেন। তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী আরো বড় দানব হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই সাকারও ফাঁসি হয়েছে। এতে করে আপাতত মুক্তিযুদ্ধের তথা বাংলাদেশের পক্ষের মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছেন।
কিন্তু ঘটনা কি এখানেই শেষ? আমার মনে হয় না। কারণ, সাকাপুত্র হুকা (হুম্মাম কাদের) চৌধুরী তার বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করে এসে জেলগেটেই মিডিয়ার সামনে যে হুঙ্কার দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে চিন্তায় পড়েছেন। সাকার মরদেহ দাফন শেষে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা হুকা প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বলেছেন। তারা কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চান? আইন-আদালত? প্রসিকিউটর-বিচারক? আপনার কিংবা আপনার মন্ত্রিপরিষদের? না কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া কবি-সাহিত্যিক-লেখক-ব্লগার-প্রকাশক-জনগণের?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন, তারা আসলে উল্লেখিত সকলের বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নিতে চান। এ থেকে কী মনে হচ্ছে? এই হুকা কিংবা হুকার মতো অন্যান্যরা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের জন্য একদিন ভয়ঙ্কর কালসাপ হয়ে উঠবেন।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, কামারুজ্জামানের ছেলেরাও এক একেকটি ভয়ঙ্কর ইয়াজিদ হয়েছেন।
একেকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করতে আপনাকে কতো বেগ পেতে হয়েছে কিংবা হচ্ছে, তা আপনার চেয়ে আর কেই বা ভালো জানে? আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের পরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যতোখানি সহজ ছিল, চুয়াল্লিশ বছর পর তাদের বিচারকাজ ততোখানিই কঠিন হয়ে গেছে। আবার যদি কোনো দিন যুদ্ধাপরাধীদের ছেলে-মেয়েদের কুকর্মের বিচার করা দরকার হয়, সেটা হয়তো এখনকার চেয়েও কঠিন হয়ে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী আপামর জনগনের মনে এখন এ বিষয়টি প্রতি মুহূর্তে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গত ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে কি বলে? রাজনৈতিক পরিবারের লোকজনই নিয়মিতভাবে রাজনীতিতে আসছেন। সেটা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত, এমনকি শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গও সেখানে ধর্তব্যের মধ্যে আসেনি। রাজনৈতিক নৃ-তত্ত্ব কিংবা সমাজতাত্ত্বিক অভীক্ষায় দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোতে পারিবারিক পরিচয় কোনো না কোনোভাবে ক্রিয়াশীল। এটি মোটামুটি এশিয়ান রাজনীতির একটি দৈব-বাস্তবতা, আমেরিকান রাজনীতিতেও একেবারে বিরল নয়।
সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসবেন কিংবা তাদেরকে নিয়ে আসা হবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের রাউজান আসনে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফাকা (ফারহাত কাদের) চৌধুরীকে বিএনপি যদি মনোনয়ন দেয়, আমি একটুও অবাক হবো না। কিংবা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যদি হুকা (হুম্মাম কাদের) চৌধুরীকে বিএনপি নমিনেশন দেয়, দেশবাসী একটুও অবাক হবেন না।
কারণ, বিএনপি এমনই। এটাই তাদের রাজনৈতিক স্বভাব কিংবা পুঁজি।
আমাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, পিরোজপুরের যুদ্ধাপরাধী দেইল্লা রাজাকার ওরফে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলেকে জামায়াত-বিএনপি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানিয়েছিল। আমার ধারণা, একইভাবে এ ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। এটিও রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের মতো একটা অবিনাশী নিরন্তর প্রক্রিয়া। মোদ্দা কথায়, বিদ্যমান ব্যবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের মানুষ এই যুদ্ধাপরাধী দানবদের বংশধরদের হাত থেকে কোনোদিন মুক্তি পাবেন কি-না সন্দেহ রয়েছে।
সুতরাং, আমাদেরকে এখনই একটি টেকসই মুক্তির পথ বের করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারগুলো যদি রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে, তাহলেই একটি টেকসই সমাধানের পথ মিলবে।
ইতোমধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় আলোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে- (১) যুদ্ধাপরাধীদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রায়াত্ত্বকরণ, (২) যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং (৩) ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। কয়েকদিন আগে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে যে, জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ৫৬১টি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে, অবশ্যই তা প্রশংসনীয় এবং সময়োচিত।
আশা করি, এ প্রক্রিয়া একটি ফলপ্রসূ লক্ষ্যে পৌঁছাবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারবর্গ যদি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীনই থেকে যায় কিংবা ক্ষমতাসীন হবার সুযোগ পায়, তাহলে তারা কিন্তু আবার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে কিংবা ব্যক্তিগত সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলবে। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গৃহীত সকল পদক্ষেপই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। রাজনীতিই যেহেতু প্রধান চালিকাশক্তি, তাই যেকোনো উপায়ে রাজনীতিতে তাদের প্রবেশাধিকার কিংবা পুনর্বাসিত হবার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। তাহলে তাদের অন্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ সংগঠনও এমনিতেই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জেনেছি, সরকার আগামী মার্চে জামায়াতকে নিষিদ্ধের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও এই কালসাপ নিধন কিংবা নির্বিষ করা যাবে না। কারণ, তারা বিএনপিসহ অন্য দলে যোগ দেবে অথবা নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করবে। তাই বলে আমি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বলছি না। শুধুমাত্র মনে করিয়ে দিতে চাই, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলেই চলবে না, তাদের অর্থের যোগান বন্ধ করতে হবে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কিংবা পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। তাই যেকোনো মূল্যে তাদেরকে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার একজন নাগরিকের একটি সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি অন্য কোনো দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে তো তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান করা হয়েছে। একইভাবে বিদেশিদের বিয়ে করার ব্যাপারে আইন করা হয়েছে।
সুতরাং, প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা পরিবারবর্গকেও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার মতো সাহসী নেতৃত্ব এবং দৃঢ়চেতা সরকার প্রধান কিংবা জননেত্রী বাংলাদেশের মানুষ পঁচাত্তর পরবর্তীকালে আর দেখেন নাই। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আপনার সঙ্গে আছেন। আপনি সকল শহীদ পরিবারের আর্শীবাদপুষ্ট। সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রাণপ্রিয় নেত্রী। আপনার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে সফলতম মাহেন্দ্রক্ষণ আপনি পার করছেন। এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা তাদের পরিবারবর্গকে এখনই নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করুন। নয়তো আর কখনোই করা যাবে না।
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন: বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুর।
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৫
এএসআর