বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাস ডিসেম্বর। পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
এ দিনেই বাঙালি জাতি অর্জন করে স্বাধীন রাষ্ট্র, লাল সবুজের পতাকা ও জাতীয় সংগীত। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ।
বিজয় দিবস প্রতিটি বাঙালির জীবনে আসে নতুন প্রেরণা নিয়ে। ৪৫ বছর আগে ডিসেম্বরের এ দিনে পাকিস্তানি সামরিকজান্তা বাঙালির দেশপ্রেমের কাছে হার মানে।
দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অমিততেজ মুক্তিবাহিনীর গৌরবদীপ্ত লড়াই আমাদের চিরদিনের অহংকার। ব্রিটিশদের নিষ্পেষণ থেকে পাকিস্তানিদের দুঃশাসনে বাঙালি যখন অতিষ্ঠ, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ছয়দফা আন্দোলনে নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন আহমেদ। মওলানা ভাসানী সংকটকালে সবসময় সংগ্রামে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শেরেবাংলা বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকেই বিকশিত করেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এক মহাকাব্য আর সেই মহাকাব্যের নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমৃত্যু আপসহীন লড়াকু শেখ মুজিব বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত একটি নাম, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারি, প্রতিবাদী ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বিতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় ও ঠিকানা খুঁজতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বঙ্গবন্ধু। দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও অর্জন করতে চেয়েছেন একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড। তিনি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন, যন্ত্রণা, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতেন এবং বীরের মতো জেগে উঠেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার বজ্রকণ্ঠকে কোনোভাবেই স্তব্ধ করতে পারেনি। তারই কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ।
পরবর্তীতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, ভাষা, আন্দোলনের পথ ধরে গণতন্ত্র ও বাঙালির আজন্ম লালিত অধিকার আদায়ের দাবিতে ৬ দফা, ৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় ও শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি, সামরিক জান্তার নিষ্পেষণ, হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতির ম্যান্ডেট নিয়ে একাত্তরের অগ্নিঝরা ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে উদাত্ত আহ্বান বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল- তা আজও বাঙালির ধমনিতে শিরহরণ জাগায়। সেদিনই বাঙালির বুকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোনা হয়ে যায়।
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কারান্তরীণ রেখেছিল, কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল। ওরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দি করলে বাঙালি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে। তারপর হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এই মুক্তি সংগ্রামের ফসল লাল-সবুজ পতাকা।
বাংলাদেশের গণহত্যার সবচেয়ে বর্বরতম অধ্যায় হলো বুদ্ধিজীবী হত্যা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ও মধ্য নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল ফরমান, কর্নেল তাজ, কর্নেল ফাতেমি, মেজর রিয়াজ, ক্যাপ্টেন তাহির প্রমুখ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাদের নির্দেশে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এদেশের শিক্ষক, সাহিত্যিক, পেশাজীবী, সাংবাদিকসহ অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। তারা আজ ৭১ এর গণহত্যা, অগণিত নারী নির্যাতনে দায় অস্বীকার করছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খণ্ডিত করার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে।
পরাজিত শক্তি এদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও নিজেদের ঘৃণ্য নিকৃষ্টতম কৃতকর্ম নিয়ে মিথ্যাচার করছে। অথচ পাকিস্তানের বিচারপতি হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং দোষী সামরিক ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের এক মানবাধিকার কর্মী ও পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী হিনা জিলানী বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়া শান্তি মিশন সম্মেলনে ১৯৭১-এর পরিস্থিতি নিয়ে তার বক্তব্যে বলেন, সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে অবিচার করেছে তা পাকিস্তানের ন্যায়চিন্তার মানুষেরা স্বীকার করেন। মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কোনো ধরনের গণহত্যা হয়নি- মন্তব্যকে বাঙালিরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
অন্ধকারের বুক চিরে প্রখর সূর্যের আলোকময় নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির কলঙ্কের দায়মুক্তির জন্য চেতনার উন্মেষ ঘটাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংকল্পে দৃঢ়ভাবে এগোচ্ছেন। জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচারকার্য, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কিছু সম্পন্ন করেছেন এবং করতে বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যেখানে আছে মেধা-মননে মুক্তিবুদ্ধির চর্চা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তবায়ন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তিকে মোকাবেলায় একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনা সদর্পে যোগ্য নেতৃত্বের কান্ডারি হয়ে দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি, কর্মক্ষম জনশক্তি, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, শোষণহীন, সমাজব্যবস্থা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠন, তথ্য-প্রযুক্তি সম্পন্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ ও আত্মমর্যাদাশীল সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একুশ শতকের এই সময়ে সর্তক পদক্ষেপে এগোচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নের রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা পূর্ণতায় রূপ পেতে এবং উন্নয়ন সমৃদ্ধ একটি স্বাবলম্বী রাষ্ট্রে পরিণত করতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিসহ ষোলকোটি জনগণের ঐকান্তিকতায় লড়তে হবে।
বিজয়ের ৪৫তম দিবসের প্রত্যাশা- অশুভ শক্তির নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করে ষোল কোটি মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে রক্ষা করার প্রত্যয়ে জাতিকে আরো তৎপর ও মনোযোগী হতে হবে, করতে হবে ত্যাগ স্বীকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সদাজাগ্রত থেকে উন্নয়নসমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে এবং মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবার নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় হোক আমাদের অঙ্গীকার।
এই বিজয়ের রক্তঝরা সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, যাদের আত্মত্যাগে আজকের বাংলাদেশ। আজকের দিনে সেসব আত্মত্যাগী মানুষদের প্রণতি জানাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সহকারী রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ০০১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
এএ