ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অষ্টম পে-স্কেল সমাচার

শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার

মো. সহীদুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নই। বেসরকারি কলেজের শিক্ষক মাত্র।

তবু আমার একুশ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার ঢালিও কম নয়। তাই এই বাস্তবতার আলোকে আমি যখন আমার কোনো ছাত্রকে নীতি-আদর্শের বিপরীতে অন্যায়ের পথে চলতে দেখি, তখন ছাত্রের এই অধঃপতনের জন্য আমি/আমরা (শিক্ষকেরা) নিজেদেরই দায়ি মনে করি। কেননা, আমরা যদি উপযুক্ত শিক্ষায় এই ছাত্রদের শিক্ষিত করতে পারতাম; তবে এমন হতো কী? অবশ্য এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তারপরও আমরা শিক্ষকরা তার দায় এড়াতে পারি না।

আজ চতুর্দিকে অফিস-আদালতে ঘুষ-দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর এজন্য প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে শিক্ষকদের উপর কমবেশি দায় বর্তায় বৈ কি! কেননা, এই দুর্নীতিবাজরা কোনো না কোনো শিক্ষকের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র। তবে কী ধরে নিতে হবে, শিক্ষকরা এই ছাত্রদের দুর্নীতির শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েছিলেন? এর সুস্পষ্ট জবাব, অবশ্যই না।

প্রকৃতপক্ষে সমাজ-পরিবেশের অবক্ষয়ের তাণ্ডবে কেউ কেউ আদর্শচ্যুত হয়েই যায়। তবে সময় বিশেষে এই আদর্শচ্যুতরাই অনেক সময় সমাজের হর্তাকর্তা হয়ে যায়।

কবি জীবনানন্দ দাশ এদের অনৈতিক আস্ফালনকে ‘অদ্ভুত আঁধার’ বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবেই আজ সমাজের এই আলোহীন চক চক সোনার মতো মেকি অন্ধরাই, ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বলে চালাতে তৎপর। সমাজে এদের দাপট অনেকটা ‘গুরু মারা শিষ্যের মতো। ’

অষ্টম পে-স্কেল নিয়ে আমলাদের সাথে সরকারি কলেজের শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন বৈষম্যের যে দ্বন্দ্ব চলছে তার সাথে উপরোক্ত আলোচনার একটা যোগসূত্র রয়েছে। আসলে এই আমলারা তাদের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের কথা একবারও কেন ভাবছে না, তা এক বিরাট প্রশ্ন! তবে কী শিক্ষকরা এই আমলাদের সেভাবে গড়ে তুলতে পারেননি!

বলাই বাহুল্য, সরকারি আমলা থেকে শুরু করে স্বল্প শিক্ষিত দিনমজুর-কামলা, কোনো না কোনো শিক্ষকের সাহচর্যে গড়ে উঠেছে। অথচ অবাক করার বিষয়, আজ সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের হাতেগড়া ছাত্র-আমলারাই অষ্টম বেতন স্কেলে শিক্ষকদের পদমর্যাদার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে?

বলাই বাহুল্য, অষ্টম পে-স্কেলে তাজ্জব করে দেয়ার মতো বেতন বাড়িয়েছে সরকার। আরো তাজ্জব করে দেয়ার বিষয় এই, এতকিছুর পরও চতুর্দিকে অসন্তোষ বেড়েছে। শিক্ষক, ক্যাডার, নন-ক্যাডার কম-বেশি সবাই আন্দোলনে। তাই জনমনে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অষ্টম পে-স্কেলের প্রণেতারা কি গোড়াতেই গলদ রেখে দিয়েছিলেন? যার চর্তুমুখি চাপ সামলাতে এখন সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে!

যদিও  বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ মুঠে-মজুর, কৃষক-শ্রমিকসহ ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ এমন লোকদেরও এই বিতর্কিত পে-স্কেলের বোঝা বাধ্যতামূলকভাবে বহন করতে হবে। আর তাতে এই নিরীহ জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস উঠবে, সন্দেহ নেই।

সত্য বলতে কী, আমি পে-স্কেলের একজন সুবিধাভোগী হওয়া সত্ত্বেও এগুলো নিয়ে ভাবি, আলোচনা করি।   কিন্তু আমার এই আলোচনায় বর্তমান পে-স্কেলের শতভাগ বেতন-বৃদ্ধির বিরোধিতা থাকায় সবাই কপালে চোখ তুলেন, বিস্মিত হন। কেউ হয়তো মনে মনে কটু কথাও বলেন। কিন্তু এটা তো অপ্রিয় হলেও ধ্রুব সত্য যে, কৃষি-অর্থনীতি নির্ভর সবেমাত্র মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাওয়া এই সোনার বাংলায় বিশাল অষ্টম পে-স্কেলের বাস্তবায়ন এই মুহূর্তে বোঝা স্বরূপ। আকারে ছোট হলেও পূর্বতন গ্রেড ও পদমর্যাদা ঠিক রেখে সবাইকে সন্তুষ্ট করেই একটি পে-স্কেল প্রণয়ন করলে উভয়কুল রক্ষা হতো। সরকারও আর্থিকভাবে স্বস্তির মধ্যে থাকতো। একই সাথে সরকার দেশে আরো বেশি বেশি উন্নয়নমূলক কাজের চিন্তা করতে পারতো। অষ্টম পে-স্কেলে এসব ভাবনার প্রতিফলন হয়নি বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। সর্বপরি এই বাজার অর্থনীতির সাথে যুক্ত হাজার হাজার বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর বিষয়টিও এখানে ভাবা হয়নি।

তবে অষ্টম পে-স্কেলে এই মুহূর্তে সরাসরি কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছেন শিক্ষকরা। তাইতো পদ-মর্যাদার প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন ধর্মঘটে, রাস্তায়। [কিছুদিন পূর্বে এমপিওভুক্তির জন্য বেসরকারি শিক্ষকরা রাস্তায় ছিলেন]। শিক্ষকরা যেন রাস্তার মানুষ। ওদের হাতে তো গোলা-বারুদ, বন্দুক নেই। ওদের রয়েছে কাগজ-কলম।

প্রকৃতপক্ষে অষ্টম পে-স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের অসন্তোষের কারণ টাকা বৃদ্ধির পরিমাণ নয়, বরং বেতন বৈষম্যের ফলে শিক্ষকদের পদমর্যাদার বিষয়টিকে ঘিরে। কেননা, দেশের শিক্ষক সম্প্রদায় মনে করেন, অষ্টম পে-স্কেলে বেতন বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার তার সামর্থ্যের ষোল আনাই প্রয়োগ করেছে। তবু পদমর্যাদার প্রশ্নে আমলাদের কাছে শিক্ষক সমাজ আপোষ করবে না, নতজানু হবে না। বলাই বাহুল্য, শিক্ষকদের পদমর্যাদার প্রশ্নে চলমান এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়; অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অনৈতিকতার বিরুদ্ধে।

আর এই শিক্ষক সমাজ, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত যারাই বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তারা সকলেই তাদের সবারই সম্মানজনক ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। একই সাথে শিক্ষার বাজেটকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ খাতে জিডিপির সর্বোচ্চ বরাদ্দের বিষয়ে আশাবাদী।

শিক্ষক শিক্ষকই। দেশ ও জাতির বিবেক, কর্ণধার ও পথ-প্রদর্শক। আর আমলা আমলাই। তবু তাদের দু’দলকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করে দেবার হীনপ্রচেষ্টা যারা করেছেন; তারা জ্ঞানপাপী।

‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার’-কবির এই বাক্য চিরকালের সত্য। এই শ্রেষ্ঠত্বের আসনকে যারা হেয় করতে চায়, তারা আসলে বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে শিক্ষকদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। সে তুলনায় ক’জন আমলা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত থেকে শিক্ষকদের মতো ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন?

শিক্ষকদের ত্যাগের ইতিহাস অবিস্মরণীয়। তবে সমাজে তাদের একটা ন্যূনতম স্বীকৃতি ও মর্যাদা পেলেই খুশি। ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ‘তালেব মাস্টার’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিত মশাই’ রচনাতে শিক্ষকদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার চিত্র ফুটে উঠেছে নিদারুণভাবে। তবু সব মেনেই নীরবে-নিভৃতে দীর্ঘকাল পথ চলেছে শিক্ষক সমাজ। কিন্তু আজ বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতিপয় আমলা এটা প্রমাণ করতে চায় যে, দেশ ও জাতির কাছে শিক্ষকদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমলারা। যা নিতান্তই ভুল, ভুল এবং ভুল। কেননা, শিক্ষকরা নেতা তৈরি করেন; নেতৃত্ব তৈরি করেন। এক কথায় আমলা থেকে কামলা সবই শিক্ষকদের সৃষ্টি।

আগেই বলেছি, শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য ন্যূনতম মর্যাদাটুকু পেলেই খুশি। বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সার প্রতি তাদের বিশেষ মোহ নেই। যদি থাকতো, তবে সমপর্যায়ের একই স্কেলপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের বিপরীতে একজন আমলা স্কেলের বাইরে যে সকল অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করেন, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করতেন।

বলাই বাহুল্য, একই স্কেলে অন্তর্ভুক্ত একজন আমলার স্কেলের বাইরে সরকারি অন্যান্য সুবিধাধি বাড়ি-গাড়ি, পিএস, এপিএস বিদ্যমান থাকলেও শিক্ষকদের তা নেই। উপরন্তু অষ্টম পে-স্কেলে বেতন স্কেলের বৈষম্য ঘটিয়ে শিক্ষকদের গ্রেডকে অবনমন করা হয়েছে।

তাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষকদের যে আন্দোলন চলছে, তার সাথে মূলত তাদের পদমর্যাদার বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেছে। তারা সরকারি আমলাদের মতো গাড়ি-বাড়ির সুবিধাদি চান না। একই সাথে আমলাদের মতো সরকারের নির্বাহী বিভাগেও প্রশাসনিক দাপট দেখানোর দাবিও করছেন না।

পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মেধা লালন ও বিকাশের ক্ষেত্র। অষ্টম পে-স্কেল নিয়ে আমলাতান্ত্রিকতা ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত করবে-যা দেশ ও জাতির জন্য হবে আত্মঘাতি। নিকট প্রতিবেশী ও উন্নত বিশ্বে পে-স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের হেয় করার এমন ঘৃণ্য চক্রান্ত কোথাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

তাই অষ্টম পে-স্কেলে বৈষম্যের প্রতিবাদে দেশ ও জাতির বিবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। যদিও এটা তাদের স্বীয় মর্যাদার দিক থেকে শোভনীয় নয়। তবে ধর্মঘটের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্ট এই অচলাবস্থার জন্য তারা নিজেরাও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এই বিষয়টি সরকারকে বুঝতে হবে।  

অতএব, এ ব্যাপারে এখনই সরকারকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক বৃত্তাবদ্ধ থেকে বেরিয়ে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষকদের পদমর্যাদা ফিরিয়ে দেবে-এটাই আজ সময়ের দাবি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ, ময়মনসিংহ

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।