ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমার ভাগ্যও হতে পারতো রীমা’র স্বামীর মতো

জোবাইর হোসাইন সিকদার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬
আমার ভাগ্যও হতে পারতো রীমা’র স্বামীর মতো ছবি: প্রতীকী

জুলাই ২০০৭। আমাদের বিয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি দ্বারে।

জিন্নাত অসুস্থ বোধ করছে দেখে পরিচিত ক’জনের পরামর্শে তাকে নিয়ে হাজির হলাম নগরীর প্রচার দৌড়ে শীর্ষে থাকা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (!) শামীমা সিদ্দিকা রোজীর চেম্বারে। নানা পরীক্ষা শেষে তিনি জানালেন, ওভারিয়েন সিস্ট অপারেশন করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শে এবং পূর্বনির্ধারিত সময়ে সার্জিস্কোপে ভর্তি করা হলো তাকে। তখনও জানি না কী ভয়াবহ মুহূর্তের দিকে যাচ্ছি আমরা...।

অপারেশন রুমে রোগীকে নিয়ে গেলেও বিশেষজ্ঞ (!) এলেন নির্ধারিত সময়ের বেশ দেরিতে। অবশ্য এসব নিয়ে রা করতে নেই। তাতে বিশেষজ্ঞ বিরাগ হতে পারেন। তাই চুপ করে জিন্নাতের আরোগ্যের আশায় অপেক্ষায় রইলাম। একসময় অপারেশন শেষ হলো। রোগী ওটি ছেড়ে কেবিনে এলো। কিন্তু সময় যত বাড়ছে তার অস্থিরতা তত বাড়ছে। রাত গভীর হচ্ছে, আমিও ক্লান্ত, জিন্নাতের পাশে তার মা, আমার শাশুড়ি আছেন। তাই বেশি না ভেবে আমি বাসায় গেলাম।

সারা রাত পাশে থাকা মা বারবার কর্তব্যরত ডাক্তারদের জানাচ্ছিলেন তার মেয়ের সংকটের কথা। অন্যরা না বুঝলেও মা তো ঠিকই টের পান সন্তানের ব্যথা। আসলে সন্তানের ভালোমন্দ কিছুই মা’দের চোখ এড়ায় না। কর্তব্যরত ডা. বলছেন এ রকম হয়, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

খুব ভোরে জিন্নাত কাতর কণ্ঠে ফোন করে আমাকে বলল, তাড়াতাড়ি এসো আমার ভালো লাগছে না।

দ্রুত গেলাম, ততক্ষণে আমার শাশুড়ি পাগলপারা হয়ে ডাক্তারদের সহযোগিতা চাচ্ছেন। আর তখনই সকালের শিফটে কাজ করতে আসা ইন্টার্নি ডা. রুম্পা গেলেন তাকে দেখতে। যেন ডাক্তার নয় এলেন শান্তির দূত। ইন্টার্নি হলেও তার আন্তরিক ও দায়িত্বশীল দৃষ্টিতে ঠিকই খুঁজে পেলেন গভীর সংকট। আমাকে বললেন রক্ত জোগাড় করেন।

সত্যি এবার আমি ভয় পেলাম। বিশেষজ্ঞের ওপর থেকে আস্থা টলতে শুরু করল। ইন্টার্নি ডা. ব্যাপারটা জানালেন বিশেষজ্ঞ (!) রোজীকে। স্বভাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ দিলেন ধমক। জানালেন তার কোনো ভুল নেই, রোগীর মনের ভুল। ইর্ন্টানি ডা. হাল ছাড়েননি। ছুটে গেলেন একই হসপিটালে অন্য রোগী দেখতে আসা প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক পিবি রায়ের কাছে। তিনি ছুটে এলেন, হাত দিয়েই টের পেলেন অসংগতি। বললেন আলট্রাসাউন্ড করতে হবে, দ্রুতই করা হলো। অধ্যাপক পিবি রায়ের কথা শুনে এরই মধ্যে হাজির হলেন সেই বিশেষজ্ঞ (!)। রির্পোট পেয়ে অধ্যাপক পিবি রায় জানালেন আবার অপারেশন লাগবে।

বিশেষজ্ঞ রোজীর বাণী ‘কিছু করলে আপনাদের দায়িত্বে আপনারা করতে পারেন। আমি কোনো সমস্যা দেখছি না। ’

অধ্যাপক পিবি রায়ের হাতে দ্বিতীয় দফা সফল অপারেশনের পর স্ত্রী আপাত রক্ষা পেলেন। অপারেশনকালে দেখা গেল বিশেষজ্ঞ (!) সিস্ট অপারেশন করতে গিয়ে নাড়িভুঁড়ি ছিদ্র করে ফেলেছেন। অপারেশনের পর তাকে যে তরল খাবার দেওয়া হচ্ছিল তা সেই ফুটো দিয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। অধ্যাপক পিবি রায়ের ছোঁয়ায় জীবনটা বেঁচে গেল, সাথে যোগ হলো আমৃত্যু ভোগান্তি। বিশেষজ্ঞের (!) ওপর ললাটে রাখা আস্থাটা এবার সত্যিই খসে পড়ল সুখতলির কিনারে।

মনে পড়ছে সেদিন সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রক্ত দিতে ছুটে এসেছিলেন সুহৃদ চিত্রসাংবাদিক রবি শংকর, বন্ধু তরুণ চিত্রনির্মাতা ও আলোকচিত্র শিল্পী মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু ও বন্ধু চিত্র সাংবাদিক রাজেশ চক্রবর্তী। পরে এসে যুক্ত হয়েছিলেন আরও অনেক প্রিয়জন।
প্রায় দুসপ্তাহ শেষে জিন্নাত হসপিটাল ছাড়ল। সংকট আরও গভীর হতো যদি তার ডাক্তার ভাই না থাকতেন। পরবর্তী প্রায় দুমাস তাদের পতেঙ্গার বাসায় ডাক্তার ভাইয়ের সেকি মমতায় ভরা পর্যবেক্ষণ। ঘরেই তিনি প্রতিদিন বোনকে দিয়েছেন আস্ত হসপিটালের চিকিৎসাসেবা। ভাইয়ের সুনিবিড় পরিচর্যায় বোন ক্রমেই উঠে দাঁড়ায়, ফিরে পায় নবজীবন। উল্লেখ্য, এফসিপিএস পরীক্ষার জন্য ঢাকায় থাকায় সেদিন তিনি বোনের পাশে থাকতে পারেননি।

পরে ২০১০ সালে আমরা ডিভি লটারি সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে এলে তার উন্নত চিকিৎসা যেমন হয় তেমনি তার কোলজুড়ে ঘর আলো করে আমাদের মাঝে আসে প্রিয় সন্তান ‘মুখর’।

প্রতিনিয়ত খুব কাছ থেকে দেখছি এখানকার ডাক্তারদের সেবার আন্তরিকতা ও রোগীদের প্রতি সম্মানের বহি:প্রকাশ। সে কি বিনয় তাদের। আহা আমাদের দেশের রোগীরা যদি তার সামান্যটুকুও পেত...।

মাত্র ক’দিন আগে একই হসপিটালে একই বিশেষজ্ঞ (!) শামীমা সিদ্দিকা রোজীর অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অকাল প্রয়াত রীমার সংবাদটি বাংলানিউজে দেখার পর আমাদের দুজনের বারবার মনে পড়ছে সেদিনের কথা। ভেসে উঠছে রীমার শিশু সন্তানটির মুখ। একটি দিনও যার সুযোগ হলো না মায়ের মমতার আলিঙ্গনে সিক্ত হবার।

রীমার পরিবার আইনের আশ্রয় নিয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে তাতে চিকি‍ৎসক সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে অসহায়দের (রোগীদের) সেবা দেওয়া বন্ধ করেছেন! দু-একজনের অসাবধানতা বা খেয়ালিপনার জন্য তারা কী পুরো পেশার ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করেননি?


জোবাইর হোসাইন সিকদার:
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন প্রবাসী সাংবাদিক



বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।