ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মায়ের দুধ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক, চীনা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ

মো. মঈনুল ইসলাম, উন্নয়ন কর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৬
মায়ের দুধ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক, চীনা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ

দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টাইমস্, সায়েন্স হেলথসহ দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গত ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে মায়ের দুধ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের খবর প্রচারিত হয়। মায়ের দুধের প্রোটিন জাতীয় উপাদান ‘ল্যাকটোফেরিন’ এর সংস্পর্শে আসা কিছু ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাককে নির্মূল করে।



অনেকগুলোর মধ্যে এটিও একটি কারণ, এর ফলে মায়ের দুধ পান করা শিশুদের উঁচুমাত্রার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়।

এ অ্যান্টিবায়োটিকটি ল্যকটোফেরিনের আকৃতি কিছুটা পরিবর্তন করে (ভাইরাসের ন্যায় ক্যাপসুল) তৈরি করা হয়েছে, যা নির্বাচিত জীবণু কোষের বহিঃস্তরে আরও জোরালো সংঘবদ্ধ আক্রমণে সক্ষম; কিন্তু আশেপাশে থাকা মানবদেহের কোষের কোনো ক্ষতি করে না।  

সিক্ল-সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস ছিলো অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি, কিন্তু বর্তমানে ক্যাপসুলগুলো এ রোগ নিরাময়ের উপকরণ সরবরাহকারী বাহন হিসেবে কাজ করতে পারে।

গবেষণাটি করেছেন ইংল্যান্ডে ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যবরেটরি (এনপিএল) ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এর একদল বিজ্ঞানী। গবেষণায় অর্থায়ন করেছে, ইপিএসআরসি, বিবিএসআরসি ও দ্য ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস, ইনোভেশন অ্যান্ড স্কিলস। গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি’ প্রকাশিত জার্নাল ‘কেমিক্যাল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে।

চীনা সংস্কৃতি
কেবল শিশু নয়, দীর্ঘদিন থেকে চীনা প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠরাও যখন স্বাভাবিক খাদ্য হজমে সমস্যা হয় তখন মায়ের দুধপান করেন।

আবার কিছু সংখ্যক চীনের মানুষ মনে করেন, মায়ের দুধ যেকোনো বয়সে শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি। ফলে এখনও চীনে দাইমা প্রথা একটি বড় ধরনের পেশা ও আয়ের উৎস।

এ সংক্রান্ত ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকায়, যা ২০০৮ সালে শুরু হয়। এ প্রতিবেদনগুলো উপস্থাপন করে, বয়োজ্যেষ্ঠ চীনাদের মধ্যে মায়ের দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জিনজিনহো হাউজহোল্ড সার্ভিস কোম্পানি’ দাইমা নিয়োগ সেবা দেয়। অন্য একটি চীনা প্রকাশনা ‘সাউদার্ন মেট্রপোলিশ ডেইলি’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্ধিত হারে বয়োজ্যেষ্ঠরা দাইমা নিয়োগ করছেন তাদের শিশুদের জন্য নয় বরং নিজেরা মায়ের দুধ পান করার জন্য।

অন্যদিকে, প্রচুর সংখ্যক মেশিন প্রস্তুতকারী চীনা কোম্পানি বহনযোগ্য যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করছেন যা মায়ের দুধ সংগ্রহ, বোতল জীবাণুমুক্তকরণ ও দুধ গরম করার কাজে ব্যবহার করা যায়। এগুলো এ.সি. ও ডি.সি. উভয় প্রকার বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে চালানো যায়। অনেক কোম্পানির তৈরি এ ধরনের প্রতিটি যন্ত্র তিন থেকে ১০ মার্কিন ডলারের মধ্যে কেনা যায়।

চীনারা তাদের আবহমান সংস্কৃতির আওতায় মায়ের দুধ ব্যবস্থাপনা ও সর্বোচ্চ ব্যবহারে অনেক বেশি অগ্রসর এবং দক্ষ একটি জাতি।  

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ডেমোগ্রফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০১৪ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে শূন্য থেকে ছয় মাস বয়সে ৫৫ শতাংশ শিশু মায়ের দুধপান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, যা ৯০ শতাংশে উন্নীত হওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু আমরা কি আশা করতে পারি, একজন বাঙালি নতুন মা তার শিশুকে জনাকীর্ণ কর্মস্থল অথবা জনসমাগম স্থলে বুকের দুধপান করাবেন? আমাদের কী যথেষ্ট পরিমাণে শিশুবান্ধব অবকাঠামো যেমন- ব্রেস্টফিডিং কর্নার, ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে? আমরা কি সন্তানকে দুধ দানকারী মায়েদের প্রয়োজন সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন?

যখন শিশুকে মায়ের দুধ পান করানো যতোটা না শারীরিক তার চাইতে অনেক বেশি মানসিক কাজ। সংসারে, কর্মস্থলে, চলার পথে আমাদের সন্তানকে দুধ দানকারী মায়েরা এবং প্রসূতি মায়েরা কি যথেষ্ট যতœ ও মানসিক সহায়তা পাচ্ছেন? একটি নি¤œ-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আগামী পাঁচ বছরে মানব উন্নয়ন খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি) আমাদের বাজেট বাড়ানোর কি তেমন কোনো সুযোগ রয়েছে?

বর্তমানে আমাদের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে এক কোটি ২০ লাখ কর্মজীবী মা রয়েছেন। জনসংখ্যা বাড়ানোর অনুপাত দেখে মনে হচ্ছে, ২০৩০ সালে ২২ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখের কাছাকাছি কর্মজীবী মা থাকবেন- তাদের সবার জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ ও অবকাঠামো নিশ্চিত করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?

এ সব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না। একটি উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ গঠনের যাত্রায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এ মুহূর্তে আয় বাড়ানোমূলক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ব্যতীত অন্যকোনো দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ নেই বললে চলে।

এ অবস্থায় আমরা আশা করতে পারি না, নিকট ভবিষ্যতে এদেশে গুঁড়ো দুধ বা ইনফ্যান্ট ফরমুলার ব্যবহার প্রতিরোধ করা যাবে।

গুঁড়ো দুধ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য বরং এটিই ভালো, মায়ের দুধ বা দাইমাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। অপার সম্ভাবনার এ বাংলাদেশে এমন কোনো উদ্যোক্তা রয়েছেন কী যিনি কাজটিকে এগিয়ে নেবেন?

মো. মঈনুল ইসলাম
উন্নয়ন কর্মী।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।