ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গণপ্রতিনিধি বনাম পুলিশ : জিব কাটো লাজে

তাইয়িব আহমেদ, কাফি কামাল, হাসান শিপলু, মাহবুবুর রহমান, মঈন উদ্দিন খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১১
গণপ্রতিনিধি বনাম পুলিশ : জিব কাটো লাজে

দৃশ্যটি খুবই বেদনাদায়ক, সংলাপগুলো লজ্জাকর। জাতীয় সংসদের একজন হুইপকে ‘শুয়োরের বাচ্চা, চড় মেরে তোর দাঁত ফেলে দেব’ বলে গালি দিচ্ছেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা! তারপর টানাহেঁচড়া, ঘুষি মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চারপাশ থেকে অনবরত লাঠির আঘাত, বুটের লাথি আর বস্ত্র হরণ।

কয়েক মিনিটের বিরতি শেষে আহত উদোম শরীরের হুইপকে ধাওয়া। আত্মরক্ষার্থে ভয়ার্ত হুইপের দৌড়। লিফটের ভেতরে পিটিয়ে চ্যাংদোলা করে পুলিশের পিকআপে তোলার পর মুহূর্তে গাড়ি থেকে পিচঢালা রাস্তায় ফেলে দেওয়া। আর এ দৃশ্যাবলির নেতৃত্ব দিয়েছেন দুজন মাঝারি সারির পুলিশ কর্মকর্তা। কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়, বাস্তব ঘটনার ‘আনকাট’ ভিডিও ফুটেজের সারসংক্ষেপ। চারদলীয় জোটের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন ৬ জুলাই রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকার ন্যাম-চত্বরে যা ঘটেছিল, যে ফুটেজটি ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে, সারাবিশ্বে। সভ্য পৃথিবীর কাছে হেট করে দিয়েছে ‘বাংলাদেশ’-এর ভাবমূর্তি। সবাই বলছে- জিব কাটো লাজে।    

রাজনীতিবিদ যেমন তার গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করবেন, তেমনি আইন-কানুন অনুযায়ী প্র্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে পুলিশ। একপক্ষের হাতে ইট-পাটকেল থাকলে অন্যপক্ষের হাতে আছে মামলা আর গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা। বিরোধীদলীয় হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক আইনবিরুদ্ধ কিছু করে থাকলে তাকে গ্রেপ্তার করে মামলা দেওয়ার ক্ষমতা তো পুলিশের ছিলই। কিন্তু আইনি ক্ষমতা উহ্য রেখে পাড়ার মাস্তানের মতো খিস্তি-খেউড় করে তার উপর হাত-পা চালানো কি শোভনীয় আচরণ! সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন! তাও ন্যাম-ভবন চত্বরে এমপিদের বাসার আঙিনায়। এটা তো রীতিমতো বাড়িতে ঢুকে নির্যাতন। কে দিয়েছে এ অধিকার? এর উদ্দেশ্যই বা কী? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা নেওয়া এসব পুলিশ কর্মকর্তা কি নৈতিকতা, সম্মানবোধ সর্বোপরি ওয়ার অব প্রিসিডেন্স সম্পর্কে অজ্ঞ? এটা কী করেছেন তারা? ঘটনার পর আত্মপক্ষ সমর্থন করলেও বিবেকের তাড়নায় কি তারা পুড়ছেন?

মিছিলে অতিউৎসাহী পুলিশি হামলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিএনপি নেতা আবদুল মতিন চৌধুরী, সাদেক হোসেন খোকা; বিএনপি সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, সাবের হোসেন চৌধুরী, বাম নেতা দিলীপ বড়–য়া, রাশেদ খান মেননসহ অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে পুলিশ। বিএনপি সরকারের শেষ দিকে জিরো পয়েন্টে লাঠিচার্জের পর রমনা জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা রাশেদ খান মেননকে উদ্দেশ্য করে তোফায়েল আহমেদকে বলেছিলেন, ‘১০টা ভোট পায় না, তার আবার রাজনীতি। ’ বর্তমান সরকারের সময়ে বিএনপির শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এমপি, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও রেহনুমা আহমেদকে পুলিশ পিটিয়েছে রাস্তায় ফেলে। প্রতিটি ঘটনাই আমাদের গণতন্ত্রের ইতিহাসে কলঙ্কচিহ্ন। তবে জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলাটি অনেক বেশি হৃদয়বিদারক, লজ্জাজনক। কারণ অন্যরা যখন হামলার শিকার হয়েছেন তখন তারা কেবল নেতা, জনপ্রতিনিধি নন। তাদের লাঠিপেটা করা হলেও অন্তত লাথি মারা হয়নি। জয়নুল আবদিন ফারুক যখন হামলার শিকার হলেন তখন তিনি সংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। আর তাকে মারা হয়েছে বুটের লাথি। তার মানে এটা নয় যে, জনপ্রতিনিধি না হলেই মারপিট গ্রহণযোগ্য। মানবিক বিবেচনায় কোনো মারপিটই গ্রহণযোগ্য নয়।

ভাবতে অবাক লাগে, একজন নির্বাচিত এমপিকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালি দিচ্ছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। যে বাহিনীর প্রধানও পদাধিকারে একজন এমপির অধস্তন। এমনকি তারা অবিবেচকের মতো লাথি মেরেছেন পিতার সমান বয়সীকে। কী অদ্ভুত! আইন প্রণয়নকারীই নিগৃহীত হচ্ছেন আইনের দোহাইয়ে। একজন পাঁচবারের নির্বাচিত এমপিকে যদি এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? একজন এমপি কি শুধুই একজন দলীয় নেতা, নাকি তার নির্বাচনী এলাকার কয়েক লাখ মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সংসদের একটি অংশ? ফলে কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ কি এটা মেনে নিতে পারে? ব্যক্তি জয়নাল আবদিন ফারুককে নিয়ে হয়তো অনেকেরই বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। তবে তিনি তো শুধু ব্যক্তি নন, দেশের মহান প্রতিষ্ঠান সংসদের অংশ। বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। রাষ্ট্রই তাকে এ মর্যাদা দিয়েছে। তাহলে এ অবিবেচনাপ্রসূত ঘটনায় কি রাষ্ট্রকাঠামোই অসম্মানিত হয়নি? একবার কি চিন্তা করে দেখবেন, পুলিশের এ আচরণ দেখার পর কোনো ভালো মানুষ রাজনীতি করতে উৎসাহী হবে কিনা। কারণ একজন জনপ্রতিনিধি দলীয় হোন আর স্বতন্ত্রই হোন, তাকে তো কোনো না কোনো বিষয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতেই হবে। আর তখন তার ওপর নেমে আসবে নির্যাতন। তাহলে কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

সচেতন মানুষমাত্রই জানেন, হরতাল-ধর্মঘট-মিছিল-মিটিং করার স্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। সেগুলো পালন বা বর্জন করাও তাদের ইচ্ছার অধীন। দেশে তো কোনো সামরিক সরকার বা রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই এ ধরনের কর্মসূচি পালন-বর্জনেও কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু দৃশ্য আর অদৃশ্যের ফারাক তো আর ঘুচে যায়নি। ফলে বিরোধী মতের প্রতিবাদে আসছে বাধা। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় বাধাটি আসছে তখনও যখন দেশ পরিচালনা করছে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী দলটি, যাদের সহযোগী হিসেবে আছেন কয়েকটি প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দল। তবে আগেও যে গণতন্ত্র চর্চায় বাধা আসেনি তা কিন্তু নয়।

বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপির পাশাপাশি প্রকাশ্যে নিন্দা ও বিচার দাবি করেছেন মহাজোট সরকারের একাধিক এমপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা। আহত অবস্থায় ভয়ার্ত ফারুকের দৌড়কে ‘গণতন্ত্রের পলায়ন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তবে প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দুঃখপ্রকাশ করলেও বাকি বক্তব্যে জাতি হতাশ। সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন, এ ধরনের পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে আখেরে সরকারের কী লাভ? রাষ্ট্রের কাছে কি মর্যাদা এবং নৈতিকতার চেয়ে কয়েকজন ব্যক্তিকে রক্ষা করাই প্রাধান্য পাবে? কারণ পুলিশ হামলার পর মামলাও করেছে। ফারুক হামলার শিকার হলেও  তার পক্ষে মামলা নেওয়া হয়নি। এটা কি অবিবেচক আচরণ নয়? উন্নত তথ্য-প্রযুক্তির সময়ে এ ধরনের ঘটনা কি লুকিয়ে রাখা সম্ভব? অথচ সব মহলই এ ঘটনায় দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চায়। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার পরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে নানা মহল থেকে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার দৃষ্টান্ত এ দেশের প্রতিষ্ঠিত। এজন্য প্রতিটি সরকারই দায়ী। ফলে এ বিচারহীনতার দৃষ্টান্ত ভেঙে বিচারের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন এখন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।

সরকার কি নৈতিকতার সে চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে? আর গণমানুষের আরেকটি প্রশ্ন, এ দেশের পুলিশ কবে সরকারের না হয়ে রাষ্ট্রের হবে?

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার সরকার ও একটি রাজনৈতিক মহলে চলছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রয়াস। আহত ফারুকের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই ঘটনার বিচার করছেন। অথচ পুলিশের মুখ আর হাত-পায়ের ব্যবহারে বিস্মিত, মর্মাহত ও হতবাক হয়েছেন দেশবাসী। রাস্তাঘাট, যানবাহন, চা স্টল থেকে অফিস-আদালত সর্বত্রই এ ঘটনা নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। ডালপালা আর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো বা পুলিশের ন্যক্কারজনক আচরণের প্রতিবাদ করা কি উচিত নয়?

লেখকবৃন্দ : গণমাধ্যমকর্মী। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।