ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গুচ্ছ কান্না, লিমনের জন্য

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১১
গুচ্ছ কান্না, লিমনের জন্য

সিডনি:“আপনার কাছে দূঃখিত এটম ভাই। কিন্তু ফোনে এখনও সে কথা বলার সাহস করতে পারিনি।

অথচ আমাদের প্রত্যাশার কাজটা তেমন আহামরি কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমি-আপনি-আমরা সেই দুর্ভাগা দেশ থেকে এসেছি। সেটিই আমাদের জন্মভূমি-মাতৃভূমি।

এটম ভাই, আমি আপনি এখন অস্ট্রেলিয়া নামের একটি মানবিক রাষ্ট্রের সদস্য। সবার উপরে এখানে মানুষ সত্য, মানুষের সম্মান। কিন্ত মনটাতো সারা সময় পড়ে থাকে বাংলাদেশে! আর সারাক্ষণ নানাকিছুতে পোড়ে! আমরা যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি সেটিও তেমন একটি মানবিক রাষ্ট্র। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্য তিনকন্যাকে নিজের মেয়ে ঘোষণা দিয়ে ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন, যে দেশেরই খোদ প্রধানমন্ত্রী! কিন্তু আফসোস! আমাদের প্রাণের সে দেশটিকেই মাঝে মাঝে আমরা চিনতে পারি না। কেমন যেন নিষ্ঠুর অমানবিক মনে হয়!”

এ লিখাটি লিমনকে নিয়ে। র‌্যাবের ভুলের কারণে যে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু। এমন দূর্ভাগ্যজনক আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। বা এখনও ঘটছে। পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিক লিমন কাহিনী পড়ে অসহায় ছেলেটির জন্য খুব মায়া হয়। ছেলেটিকে চিকিৎসার জন্য অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে। তেমন একটি উদ্যোগও হয়েছিল। এদেশে আনতে পারলেও কিন্তু আমরা লিমনের হারানো পা’টি ফেরত দিতে পারতাম না। কিন্তু এমন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষজনের জন্য গড়ে ওঠা কিছু উন্নত চিকিৎসা-প্রযুক্তি, বিকল্প সাপোর্টের ব্যবস্থা করা যেত। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরও নিরাপত্তার কারণে দেশে ঝালাঠির গ্রামে ফেরত যেতে পারেনি লিমন। এদেশটায় এসে কিছুদিন থেকে গেলে সে সমস্যাও সাময়িক এড়ানো যেত। অন্তত কিছুদিন ভালো থাকতে পারতো ছেলেটি। কিন্তু পারলাম না!

এদেশে নিজস্ব সামর্থ্য সীমিত। মিডিয়ায় লম্বা ক্যারিয়ারের কারণে কিছু জানাশোনা থাকায় সামর্থ্যবানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে-রেখে অসহায় চিহ্নিতদের সহায়তা দিতে চেষ্টা করি। এখানে উল্লেখিত এটম ভাই অর্থাৎ এটম রহমান তেমন দয়ালু মানুষ একজন। ভদ্রলোক মেলবোর্নপ্রবাসী ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ থেকে অসহায় রোগীদের অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এসে চিকিৎসায় সহায়তা দেন। বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারি জোড়া লাগানো শিশু তৃষ্ণা-কৃষ্ণার অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। তৃষ্ণা-কৃষ্ণা এখন অনেক ভালো আছে অস্ট্রেলিয়ায়। মেয়েদের দেখতে মাঝে মাঝে তাদের মা’কে দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। এমন অদ্ভূত অস্বাভাবিক বাচ্চাদের লালল-পালন করতে পারবেন না মনে করে খুলনার এক এতিমখানায় মেয়েদের দাবি লিখিতভাবে ছেড়ে এসেছিলেন যে দরিদ্র মা!

বিডিআর’এর ঘটনায় ঝিকাতলার ফুটপাতে গুলি লাগা এক চা বিক্রেতা কিশোরের অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেছিলেন এই এটম রহমান। আমার অনুরোধে লিমনের জন্যেও তেমন একটা ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন।

এসব চিকিৎসায় ভদ্রলোক মূলত মেলবোর্নভিত্তিক একটি এনজিও’র সহায়তা নেন। এনজিওটি প্যাকেজটি চূড়ান্ত করলে কোনও একটি এয়ারলাইন্স ফ্রি টিকেট, হাসপাতাল ফ্রি শয্যার ব্যবস্থা করে। ডাক্তার-সার্জনরা দান করেন তাদের সময়। এসবের আগে পিছের বাকি সময় রোগীকে রাখা হয় এনজিও’র সেল্টার হোমে। কাজেই পুরো মিশনটির কোথাও আর্থিক লেনদেনের যোগাযোগ নেই। এখানে লিমনকে নিয়ে আসতে পারলে আমরা তাকে কোনও তহবিল বা টাকায় বড়লোক করে দিতে পারতাম না। কিন্তু যা দিতে পারতাম তা টাকায় বাংলাদেশে সম্ভব না।

যে কারো বিদেশে চিকিৎসার প্রসেসিং’এ প্রাথমিক কি কি বিষয়াদি লাগে তা সবাই জানেন। প্রথম দরকার সংশ্লিষ্ট ডাক্তার বা মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট। যারা রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরপর পাসপোর্টসহ অন্যান্য ছাড়পত্রের বিষয়াদি জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এসব বিষয়ে সহায়তা বের করা যায়নি। দেশে লিমনের বিষয়টি তদারকিতে প্রত্যক্ষ জড়িত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, আইন ও সালিশকেন্দ্রের কর্মকর্তাসহ একাধিক মিডিয়া-কর্মীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ করেছি। শুরু থেকে সবাই বলছেন হয়রানির ভয়ে কোনও ডাক্তার সাহস পাচ্ছেন না। পাসপোর্টের ব্যাপারেও কোনও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি! ভয়ের কারণ নাকি সরকার। রাষ্ট্র!

আমার দেশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কি প্রশ্ন করতে পারি, কিসের এত ভয়? লিমনের মতো একটা অসহায় ছেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ আসতে পারলে বাংলাদেশ কি উল্টে যেত? আওয়ামী লীগ, এর সরকার কি এতই ভয়ংকর, বাজে কিসিমের দল-সরকার? এই দলটির নেতৃত্বেই তো স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কোন কিছুরই কোনও জবাব-সদুত্তর কারও কাছে নেই।

এমন সবকিছু মনে করে মাঝেমাঝে ব্যর্থতায় শুধু হাত-পা ছুঁড়েছি। অসহায় কেঁদেছি একা। এটাই কি আমার দেশ? আমরাতো এই দেশটাকে চিনি না! নিজস্ব ব্যর্থতা-অসহায়ত্বের বড় আরেকটি কারণ, আমার প্রিয় এটম ভাই তথা এটম রহমানকে এ বিষয়ে কনভিন্স করলাম, তিনি তাঁর ডোনারদের রাজি করালেন, কিন্তু দেশ থেকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট না পাওয়াতে পুরো উদ্যোগটিই পরিত্যক্ত-ভন্ডুল হয়ে গেল!

চিকিৎসার জন্য লিমনেরও অস্ট্রেলিয়া আসা, এই সুন্দর মানবিক দেশটি দেখা হলো না! অতএব এখনও কোথাও লিমনকে নিয়ে কোনও রিপোর্ট পড়লে শুধু অসহায় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি-আমরা তোমার জন্য একটা কিছুর চেষ্টা করেছিলাম লিমন, পারলাম না। এখনকার এই দেশটা আমার না। এই দেশ এই সরকারকে আগে যা চিনতাম জানতাম, এটি সেটা না। সরি অ্যান্ড থ্যাং ইউ এটম রহমান ভাই।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।