ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

একাত্তরে মুজিব-ইন্দিরা-নিকোলাই বনাম নিক্সন-ইয়াহিয়া-চৌএন লাই

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬
একাত্তরে মুজিব-ইন্দিরা-নিকোলাই বনাম নিক্সন-ইয়াহিয়া-চৌএন লাই (ওপরে বাঁ থেকে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী ও নিকোলাই পদগর্নি; (নিচে বাঁ থেকে) ইয়াহিয়া খান, রিচার্ড নিক্সন ও চৌ এনলাই

আমাদের স্বাধীনতা কেবল মুক্তিযুদ্ধে সামরিক যুদ্ধের বিজয় ছিলনা, এর পেছনে ছিল এক গভীর, জটিল ও নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লড়াই। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণের সাথে সাথেই মূলত সে কূটনৈতিক লড়াইয়ের সূচনা।

আমাদের স্বাধীনতা কেবল মুক্তিযুদ্ধে সামরিক যুদ্ধের বিজয় ছিলনা, এর পেছনে ছিল এক গভীর, জটিল ও নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লড়াই। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণের সাথে সাথেই মূলত সে কূটনৈতিক লড়াইয়ের সূচনা।

সামরিক যুদ্ধের মতোই যা পরবর্তী ৯ মাস  ধরেই চলতে থাকে।

এখানে একটি বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক যে পৃথিবীর দুটি মাত্র রাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রথমটি আমেরিকা। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়। এর প্রায় ২০০ বছর পর এক এতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেই।   তবে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-আইনগত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার চেয়েও আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটটি ছিলো অনন্য।

এপ্রিলের প্রথম দিক থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্ত্বিত করার জন্য একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করার তোড়জোড় শুরু হয়। তাজউদ্দীনের আহমদের নেতৃত্বে ১০ এপ্রিল একটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল এ সরকার শপথ নেয়। সেদিন থেকেই প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হয় মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্ন থেকেই যখন ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানান।

ভারত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্ন থেকেই এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। ২৬ মার্চের একটি ঘটনা উল্লেখ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ওইদিন দিল্লিতে দুপুরের দিকে ভারতের লোকসভার অধিবেশনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার শুরুতেই লোকসভার সদস্য সময় গুহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংশতার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বিষয়টি আসিয়ানভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে জাতিসংঘে তুলে ধরারও আহবান জানান।

পরের দিন (২৭ মার্চ) রাজ্য সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওইদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরন সিংহ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধী আলোচনায় বলেন, ‘বাংলাদেশ জনগণের সীমাহীন দুঃখ বেদনার সঙ্গে আমরা শুধু সহমর্মীতা প্রকাশ করছিনা, তাদের এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্ত করার বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট’।

৩১ মার্চ লোকসভা এবিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যাতে বলা হয়, ‘This House records its profound conviction that the historic upsurge of the 75 million people of the East Bengal will triumph. This House wishes to assure them that their struggle and sacrifice will receive the whole hearted sympathy and support of the people of India’.

এভাবেই ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভা পৃথকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কাজেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সমর্থনের পেছনে তার যথাযথ রাজনৈতিক ম্যান্ডেটও ছিল। কারণ, লোকসভা ও রাজ্যসভা-উভয় হাউজই সেদিন তাকে একাজে ম্যান্ডেট দিয়েছিল। এখানে আরো বলে রাখা প্রয়োজন যে শুধু কংগ্রেস বা সরকারি দলই বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেনি, ভারতের বিরোধীদলগুলো ও তাদের নেতৃবৃন্দ এ একইভাবে বাংলাদেশ প্রশ্ন সোচ্চার ছিল। যেমন ৭ মে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বিরোধীদলের এক বৈঠক হয়। সেখানে ড: করণ সিং ও মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান। বিরোধীদলগুলো কেবল বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়ার কথাই বলেন নি, সেই সাথে অতিদ্রুত বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ারও জোর দাবি জানিয়েছিলেন।

আমরা কিছুতেই ভুলতে পারবো না অটল বিহারী বাজপেয়ী (পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ যাকে মরণোত্তর সম্মাননা দিলো), ইন্দজিত গুপ্ত, একে গোপালন, কে মনোহরণ, চিত্ত বসুসহ এমন আরো অনেকের অবদানের কথা।

এভাবে ভারত প্রথম থেকেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেটি শুধু রণাঙ্গনে নয়, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রবাসী সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।

সোভিয়েত ইউনিয়নও তখন পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তানের শাসকচক্রের ব্যর্থতাকে দায়ি করে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পূর্ব-পাকিস্তানের অবিসংবাদিত ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে এই পরিস্তিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধানেরও তাগিদ দেন।

পরাশক্তির মধ্যে চীন, আমেরিকা শেষ পর্যন্ত আমাদের বিপক্ষেই থেকেছে। যদিও আমেরিকা শেষ পর্যন্ত অবশ্য নৌবহর পাঠায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান-চীন ও আমেরিকা-পাকিস্তান ঐতিহাসিক সম্পর্কের জেরটিই বেশিই কাজ করেছে। যে কারণে পাকিস্তান সহজেই আমেরিকা ও চীনকে তাদের পক্ষে টানতে পেরেছে। একইভাবে ভারতও সহজেই রাশিয়াকে কাছে টানতে পেরেছে।

পাকিস্তান ও চীন-এই দুইটিই ভারতের প্রতিবেশি। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানকে এক চিঠি লেখেন যাতে তিনি বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানে আক্রমণ করলে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণকে তাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে চীনের সরকার ও জনগণ দৃঢ় সমর্থন দেবে’। বাংলাদেশকে সমর্থন মানে এমন দুই শক্তিশালী প্রতিবেশিকে ক্ষেপিয়ে তোলা-যা ভারতের জন্য সেসময়ে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি ছিল। কিন্তু চৌ এন লাইয়ের হুমকি সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহত রাখে। এখানে ইন্দিরা গান্ধীর একটি উক্তি প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থনে আমাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবেনা’। তবে চীনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলো চীন বহুবার হুমকি দেয়া সত্ত্বেও বিশ্বের কোনো আঞ্চলিক সামরিক সংঘাতে জড়িত হয়নি। হয়তো ভারতের বিবেচনাটি কাজ করে থাকতে পারে।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে এ অঞ্চলে শক্তির একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক কাযর্ক্রম পরিচালিত হয়েছে। যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন গোপন নথি প্রকাশের ফলে আজ  স্পষ্ট।

একদিকে আমাদের প্রবাসী সরকার ও ভারত বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আর অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানওতো বসে থাকলেন না। তিনিও আমেরিকাকে নানাভাবে তোয়াজ করতে থাকলেন, চীনকে বোঝালেন। তবে পাকিস্তানের সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যেই পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে গোপন করা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান এখানকার আসল ঘটনা লুকিয়ে নিক্সনের কাছে এক চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি পরিস্থিতির জন্য শেখ মুজিবকেই দুষলেন। সেই দোষ চাপালেন ভারতের ওপরও। তিনি যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা করলেন আর সেই সাথে নিধনযজ্ঞে মেতে উঠলেন সে কথা বেমালুম চেপে গেলেন নিক্সনসহ অন্যন্য পরাশক্তিগুলোর কাছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করলেন তখন তিনি তাকে পূর্ব-পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্মক অবহিত করলেন। রাষ্টদূত কিটিংকেও একইভাবে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। সব জেনে হেনরি কিসিঞ্জার ভারতের প্রতি আরো রুষ্ঠ হলেন ও ভারতকে সব ধরনের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। ইয়াহিয়া বা কিসিঞ্জার না জানালেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স মারফত পূর্ব-পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হতেন। কিন্তু তারপরও তিনি পাকিস্তানকে একতরফা সহায়তা দিয়ে গেছেন।
 
৩১ অক্টোবর বৃটিশ প্র্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ও ইন্দিরা গান্ধি বৈঠক হয়। ইন্দিরা গান্ধী এরপর নিক্সনের সাথেও বৈঠক করেন। বৈঠক করেন ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাথেও। যদিও এতে কারো মন গলেনি। । ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কও পাকিস্তানের পক্ষ নেয়।

এরকম আরো অনেক চড়াই-উৎড়াই পাড় হয়েই একাত্তরের কূটনৈতিক লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়েছিল। স্বাধীনতার যু্দ্ধ একটি সামগ্রিক লড়াই। সবার মরণপণ লড়াইয়ের ফলেই আজকের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশ সময় ১৮০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬
ইএপি/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।