জ্বলেছে বাংলা, ধর্ষিতা হয়েছে নারী, খুন হচ্ছিলো শিশু। অবরুদ্ধ বাংলায়, একাত্তরে।
তবুও ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের কাছে নতি স্বীকার করেনি বাঙালি। ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ নেমে পড়েছিলো। তারা বের হয়ে পড়েছিলো তাদের মাতৃভূমি রক্ষায়। অন্ধকারেই ঝাঁপ দিয়েছিল দু’যুগের শোষণ-বঞ্চনা আর নির্যাতন-হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধে প্রজ্জ্বলিত হতে থাকা দ্রোহী মানুষগুলো। যেন আগুন লাগে বাঙালির হৃদয়ে। ‘সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে’।
পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বাঙালির মাঝেও জ্বলতে থাকে সে আগুন ধিকি ধিকি। পাকিস্তানিদের পর্যদুস্থ আর পরাভূত করে যুদ্ধজয়ের আকুলতায় আটলান্টিকের এপারে শুরু হয় অস্ত্রহীন আরেক মুক্তিযুদ্ধ।
ভয়াল ২৫ মার্চের কালো রাত। সারা দেশটা যখন ডুবেছিলো অন্ধকারের অতলে, পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নিরীহ বাঙালির ওপরে। শুরু হয় বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ জয়ের অভিপ্সায় যেমন অকাতরে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন আমাদের লাখ লাখ তরুণ, ঠিক তেমনি এই প্রবাসে বাঙালিরাও হয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ।
বাঙালির নিজস্ব সত্ত্বা আর স্বরুপ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ব্রিটেনের বাঙালিদেরও দোলা দেয়। গর্জে ওঠেন তারাও। লাখো মুক্তিযোদ্ধা যখন আলো আর আঁধারে শত্রু নিধনের অঙ্গীকার নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিংবা মৃত্যুকে বরণ করে সম্মুখ সমরে লড়ছেন, তখন এখানেও চলেছে যেন আরেক যুদ্ধ।
প্রতিদিন এই প্রবাসের মানুষগুলো নিয়েছেন নতুন নতুন পদক্ষেপ। প্রতি প্রভাতেই তারা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তুলে দিয়েছেন নতুন নতুন সংবাদ।
পাকিস্তানি হাইকমিশনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন মানুষ। গ্রেফতারও বরণ করতে হয়েছে ১১ জনকে। গ্রেফতারকৃতদের মাঝে একজন ইব্রাহিম আলীকে ছয় সপ্তাহের জন্য কারাগারেও যেতে হয়। ক্রমেই জন্ম নিতে থাকে পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা। অবিশ্বাস আর ঘৃণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি আর বাঙালির মাঝে বাড়তে থাকে বিদ্বেষ।
দাঙ্গা-কলহ হয়ে ওঠে এক নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এরই নির্মম শিকার হন আব্দুন নুর নামের একজন। বৃহত্তর সিলেটের ওই আব্দুন নুরই সম্ভবত প্রথম কোনো মানুষ, যিনি স্বাধীনতার নাম নিয়ে প্রবাসে শহীদ হন কোনো এক পাকিস্তানির হাতে।
এ হত্যাকে সাধারণ হত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও এটি কি আসলেও তাই? কারণ, এটি ছিলো পাকিস্তানি আর বাঙালির দ্বন্দ্ব এবং জাতিগত এ দ্বন্দ্বেরই নির্মম পরিণতিতে স্বাধীনতার বলি হলেন আব্দুন নুর।
আর এ অর্থে তিনিও একাত্তরের শহীদ।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দেওয়া তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবু সাঈদ চৌধুরীর লন্ডন পাড়ি দেওয়ার মধ্য দিয়ে এখানে সংগঠিত হতে থাকে ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপল্স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে’, ব্রিটেনের শহরে শহরে। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তার প্রয়োজনে জমা হতে থাকে হাজারো-লাখো পাউন্ড। আওয়ামী লীগ তো বটেই, সাধারণ মানুষও যার যার অবস্থান থেকে নিয়েছেন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।
ঐতিহাসিক হাইড পার্কে হয়েছে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বামপন্থি দল, বাংলাদেশি পেশাজীবী, নারীদের নিজস্ব ব্যানারে সভা-সমাবেশ ইত্যাদি তাক লাগানো সব কর্মসূচিও চলে এই ব্রিটেনে। স্বাধীন হওয়ার আগেই বার্মিংহামে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের চিৎকার প্রতিধ্বনিত করা হয়েছে সারা বিশ্বে।
আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে আরও অনেকে যার যার অবস্থান থেকে করেছেন ব্রিটিশ এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক। আন্তর্জাতিক সমর্থন আর দৃষ্টি আকর্ষণে কার্ডিফ শহরের ৫ জন বাঙালির সাহসী আর সময়োপযোগী উদ্যোগ সাড়া জাগিয়েছে তখন। একাত্তরের ১৩ মে ওই পাঁচজন সাহসী বাঙালি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে আলোচনার দাবিতে অনশন শুরু করেন। ১৪ মে আলোচনা অনুষ্ঠিতও হয়। ২০ জন সাংসদ বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন। ১৫ মে ব্রিটিশ মিডিয়ায় এর গুরুত্ব বাড়ে। সারা পৃথিবীতে প্রতিফলিত হয় বাংলাদেশ। তারপর একে একে চলতে থাকে প্রবাসীদের অপেক্ষা।
প্রবাসীদের এসব আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে সে সময় ব্রিটেনের গণমাধ্যমগুলো ছিলো সোচ্চার। ব্রিটেনের মূলধারার প্রভাবশালী কাগজগুলো, যেমন টাইমস, টেলিগ্রাফ, ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড, গার্ডিয়ান ইত্যাদিতে চিত্রায়িত হয়েছে বাংলাদেশের লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের কথা। একমাত্র আমেরিকা কিংবা পাকিস্তানপ্রেমী দেশগুলো ছাড়া সব দেশেই পড়েছে যার ইতিবাচক প্রভাব।
ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজ কিংবা সাময়িকীগুলো রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও লড়াকু আর শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার উদ্দীপনা যোগাতে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশের বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রকাশ করেছেন মুক্তবাংলা, জয়বাংলা, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সাপ্তাহিকী কিংবা পাক্ষিক। ঠিক তেমনি ব্রিটেন থেকেও বের হয়েছে বিদ্রোহী বাংলা, স্বাধীন বাংলাসহ বিভিন্ন সাময়িকী কিংবা নিউজ টুডেসহ বিভিন্ন বুলেটিন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের প্রবাসী মুখপত্র হিসেবে একমাত্র নিয়মিত কাগজ সাপ্তাহিক জনমতও বের হতো লন্ডন থেকেই। এ সাপ্তাহিকীটির অবদান নিঃসন্দেহে ঔজ্জ্বল্যের। প্রবাসের বাঙালিদের জন্যেতো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ব্রিটেনে জনমত গঠনেও এ পত্রিকাটির অবদান ঐতিহাসিক। প্রবাসী বাঙালিরা এ থেকে পেতেন সে সময়কার পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের খবর, পেতেন প্রত্যাশার খবর, দীর্ঘ ন’টি মাস উজ্জীবিত আর উদ্দীপ্ত হওয়ার শেষে পেয়েছেন বিজয়ের বার্তাও।
স্বাভাবিক কারণেই ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিদের প্রত্যাশাও আছে। এ প্রত্যাশা শুধু স্বাধীনতার সময় অবদান রাখার কারণেই নয়। চেতনায় বাঙালিয়ানা নিয়ে এখনও ব্রিটেনের প্রবাসীরা দেশের সার্থকতায় হাসেন উজ্জ্বল হাসি। সংকটময় সময়ে তারা দিয়ে যান অকৃপণ সহযোগিতা।
স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে। এখনও যদি হিসাব মেলান প্রবাসীরা, দেখা যাবে হিসেবের খাতায় জমানো অনেক ক্ষোভ, অনেক হতাশা।
আমরা স্বীকার করি, বাংলাদেশই হয়তো তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বার বার ক্ষমতার অগণতান্ত্রিক পালাবদল সারা দেশটার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কিংবা মানুষের আকাঙ্খা যেন সব সময়ই থেকে গেছে স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারীদের শাসন আর শোষণের অন্তরালে।
তবু এর মাঝেও থেমে থাকেনি, বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বীকৃতি এসেছে অনেক কিছুরই। সম্মান দেওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ওডারল্যান্ড আর ব্রিটেনের ভ্যালরি টেইলরকে। সম্মান দেওয়া হচ্ছে বাইরের দেশের অনেক অকুতোভয় মানুষদেরকেও। ভারতের অনেক যোদ্ধা, যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদেরসহ প্রায় ১৭০০ পরিবারকে সম্মান জানাতে বর্তমান সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি তাদের পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু একজন সাধারণ প্রবাসী আব্দুন নুর (শহীদ আখ্যার বিচার পাঠকদের হাতে) কিংবা তার সতীর্থদের কি পাওয়ার কিছুই নেই? রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন আবু সাঈদ চৌধুরী। এটি তার পাওনা ছিলো। এটি তিনি পেয়েছেন দেশের একজন হয়েই, প্রবাসী হিসেবে নয়। কিন্তু একজন আব্দুন নুর কিংবা ইব্রাহিম আলীদের কি দিতে পেরেছে আমাদের দেশ তার ন্যায়ত সম্মানটুকু?
এ প্রশ্নগুলো বার বার উচ্চারিত হতেই থাকবে এই প্রবাসে।
ফারুক যোশী: লন্ডন প্রবাসী লেখক
বাংলাদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
এএসআর