ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৭
‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন স্বাধীনতার রক্তকথন

ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু পর্দার অন্তরালে তিনি নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন।

এ লক্ষ্যে তিনি ভুট্টো ও টিক্কা খানকে কাজে লাগালেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিনি কয়েকবার ঢাকা আসা-যাওয়া করেন।

করাচি ফিরে গিয়ে তিনি ভুট্টোকেও ঢাকা পাঠালেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। তারা দুজনেই একরকম ব্যর্থ হয়েই করাচি ফিরে গেলেন।
 
গণহত্যার আগে শেষবারের মতো ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন ১৫ মার্চ। ঢাকায় এসে তিনি জাতীয় পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে আলোচনা করেন। সেই সঙ্গে ছয় দফা নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু শেখ মুজিবের কাছে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার পদে থাকার বিষয়টির ওপরই বেশি গুরুত্বারোপ করেন।
 
ইয়াহিয়ার পর ভুট্টোও একই টালবাহানা করেন। ভুট্টোর দাবি, সংবিধান প্রণয়নের আগে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করতেই হয়ে তবে পাকিস্তানের উভয় অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছেই তা করতে হবে। ভুট্টোর দল জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পশ্চিমাংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভুট্টোর ফরমুলা সেনাবাহিনী আন্দোলন দমনের একটি কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেন। ইয়াহিয়া তার সেনাবাহিনীকে সেভাবেই ভেতরে ভেতরে ইঙ্গিত দিতে থাকেন। তিনি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ লক্ষ্যে যোগাযোগ রাখতে থাকেন।
 
হাসান জহীরের ‘দ্য সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দ্য রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম’ বইতে ইয়াহিয়ার এ পরিকল্পনার কথা জানা যায়। লেখক তার বইয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেও  ইয়াহিয়া  খান সামরিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন এবং ক্যান্টনমেন্টে আর্মি অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। প্রতিটি পরিদর্শন ও আলোচনার পরই তিনি সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং সেনাবাহিনী যে খুব সহজেই এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, সে বিষয় অতি সরলীকৃত মত প্রকাশ করেন।
 
আসলে তিনি নিজে সামরিক বাহিনীর লোক। তাই রাজনৈতিক সমস্যারও সামরিক সমাধানের পথ খুঁজতে থাকেন। সে কারণেই সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা তিনি প্রচণ্ড প্রভাবিত হন। তিনি ভাবেন, রাজনীতিবিদদের কাছে নতি স্বীকার করার তার কোনো প্রয়োজনও নেই এবং এটা তার উচিতও না।
 
বাঙালি ইয়াহিয়া-ভুট্টোর এ গোপন অভিসন্ধি আঁচ করতে পারে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবারও স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইয়াহিয়ার এ অভিসন্ধিকে তারা গণতন্ত্রবিরোধী এক নাশকতা হিসেবে বিবেচনা করে। আসন্ন পাকিস্তান দিবসকে সামনে রেখে তারা এক কর্মসূচি নেয়। যা ০২ মার্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার এক ধারাবাহিকতা। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বাঙালি বাংলাদেশের সর্বত্র তাদের নতুন পতাকা উত্তোলন করার কর্মসূচি পালন করে। এর আগে ০২ মার্চ আ স ম রবের নেতত্বে বাংলার এ নতুন পতাকা তারা উত্তোলন করে।  
 
লে. জেনারেল জে এফ আর জেকব তার বইয়ে লেখেন, “২৫ মার্চ বিকেলে ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত গোপনে ঢাকা ছাড়েন। তিনি কলম্বো হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। টিক্কা খান ২৬ মার্চ মধ্য রাত (২৫ মার্চ দিনগত রাত) একটায় (সেনাবাহিনীকে) আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে রাখেন’। এর ব্যাখ্যায় জেকব বলেন, ‘হিসাবটা ছিলো এই যে, প্রেসিডেন্ট (ঢাকা ত্যাগ করে) ততক্ষণে করাচী পৌঁছে যাবেন”। হলোও তাই।
 
ভুট্টোও ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য সেনাবাহিনীকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। পরিকল্পনা ছিলো রাত ১টায় বা তার পরপরই ঢাকাবাসীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। কিন্তু তার দুই ঘণ্টা আগেই শুরু হয়ে যায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। সেনাবাহিনী যেনো ইয়াহিয়ার ঢাকা ছাড়ার অপেক্ষায় ছিলো। ২৫ মার্চ রাত এগারোটায় সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে রওয়ানা দেয়। পাকিস্তানিদের রক্তখেলা বাস্তবায়নের জন্য তারা ঢাকাবাসীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। ঢাকায় তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানিরা সব ধরনের ভারী অস্ত্র প্রয়োগ করে। ফলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই ঢাকা দখলদারদের দখলে চলে আসে। কয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ হয়। কিন্তু আগে থেকে সুনির্দষ্ট তথ্য না থাকায় ও অস্ত্রের অভাবে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ও ইপিআর হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তান বাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টোর অভিনন্দন কাজে লাগলো না। কারণ, বাঙালি প্রথম আঘাত সামলে অতিদ্রুতই প্রতিরোধ গড়ে তোলে যা পরে পুরো দেশে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তর হয়।  
 
এদিকে, রাত ১টার দিকে শেখ মুজিবকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনদিন পর তাকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। সব বিদেশি সাংবাদিকদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অন্তরীণ রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের অতি দ্রুত নিজ দেশে ফেরত যেতে আদেশ দেওয়া হয়। সাংবাদিকরাও নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও তাদের নিজেদের দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। সে সময়ের সংবাদমাধ্যমে বিদেশিদের দেশ ত্যাগের কথা জানা যায়।
 
প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এ আক্রমণের প্রভাব পড়ে। জনগণ পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। তারা সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে যেনো সরকার বাংলাদেশের নিরস্ত্র বাঙালিদের পাশে দাঁড়ায়। তারা সরকারকে পাকিস্তানে হস্তক্ষেপের আহবান জানান। ৩১ মার্চ ভারতীয় সংসদে পাকিস্তানকে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিন ইন্দিরা গান্ধী নিজেই এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের বর্ণনাই দেওয়া হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
এসএনএস

আগের পর্ব পড়ুন:
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।