ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৭
নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলো তাদের নিজ নিজ স্বার্থবলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। ফলে একাত্তরে এখানে সংকট মোকাবেলায় কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে এ সংকটের সূচনা করেন। যদিও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল দুই যুগ ধরেই।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তান তার বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান এই দুই পরাশক্তির দাপট দেখাতে থাকে। তার সঙ্গে যোগ হয় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি মুসলিম দেশ।

সে তুলনায় মিশরের ভূমিকা ছিল ভিন্ন।

বাংলাদেশ প্রশ্নে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং সেইসঙ্গে ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া ছিল নমনীয়। তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কূটনৈতিক-সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ভারত প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে। সেদেশের রাষ্ট্র ও সরকার সবাই বাংলাদেশ প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতো। যদিও বাংলাদেশকে ভারত কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ভারতের সরকার ও জনগণ ছিল আমাদের পক্ষে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক কার্যক্রমের একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পাওয়া যায় ভারতের তৎকালীন লোকসভার সদস্য অধ্যাপক সমর গুহের একটি লেখায়। ১৯৭১ সালের ২৩ মে তিনি একটি নিবন্ধ লেখেন। এরকম নিবন্ধ সে সময় ভারতের অনেক সংবাদপত্রেই আসে। অধ্যাপক গুহ বলেন, ‘রাশিয়ার সম্মতি ও সহযোগিতায় চীনা ফৌজ কোরিয়ায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম, লাওস বা কম্বোডিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনের জাতীয় স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে চীন এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। চীন বহুবার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের কোনো অঞ্চলের সামরিক সংঘাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার হয়নি। ’

এই নিবন্ধে তিনি ঐতিহাসিক নজির টেনে বলেন, ‘চীন যাই বলুক না কেন তারা কখনো শক্তি প্রয়োগ করেনি এবং বাংলাদেশ প্রশ্নেও সে শক্তি প্রয়োগ করবে না। চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য প্রত্যক্ষ শক্তি প্রয়োগে অবতীর্ণ হবে, এরূপ চিন্তা আশঙ্কার সামিল। তাছাড়া চীন জানে যে আসন্ন বর্ষার সময়ে পূর্ব বাংলায় বা পূর্বাঞ্চলে বা ভারতের কোনো প্রান্তে বড় রকমের সৈন্য চলাচল করা এক অসাধ্য ও বিড়ম্বিত কাজে পরিণত হতে বাধ্য। ’

অধ্যাপক গুহ আরও বলেন, ‘চীন এ কথা জানে যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে রুশ মার্কিন সমর্থন ও সহযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও বেইজিং যদি পাকিস্তানের খাতিরে ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়, তাহলে রুশ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে দূরে সরে থাকতে পারবে না। ’

অধ্যাপক গুহ মনে করেন, ‘মার্কিন সমঝোতার সম্ভাবনাকে টেনে ফেলে দিয়ে চীন পাকিস্তান রক্ষায় নিজের জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করবে, এরূপ আন্তর্জাতিক উগ্র আচরণ চীন কখনও দেখায়নি। বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রশ্নে চীন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে চীনের আদর্শবাদী পঞ্চশীলা যা তার পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কীভাবে কলঙ্কিত হবে সে কথাও চীনকে বিবেচনা করতে হবে”। অধ্যাপক গুহ ওই কথাগুলো বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা রহস্যজনক। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ সচিব স্যার ডগলাস হিউস ২৯ মার্চ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক ভাষণে বলেন, ‘পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী যে দুঃখজনক এ বিষয়ে আমরা সব সদস্যই একমত। একটি সার্বভৌম দেশের দুই অংশের মধ্যে সাংঘাতিক সংঘর্ষ সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ’

৫ এপ্রিল তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো অভিপ্রায় ব্রিটিশ সরকারের নেই। ’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে বলেন, “we have to respect the territorial integrity of Pakistan and its sovereignty as a state”. যদিও লেবার পার্টির ১২০ জন সদস্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের সরকার ও নেতৃত্ব একটি দ্বিধাবিভক্ত জায়গায় অবস্থান করছিল। তবে যুক্তরাজ্যের জনগণ বাঙালির পক্ষে নানাভাবে কাজ করেছে।

এদিকে ইয়াহিয়া খানও বসে ছিলেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে বাংলাদেশে পরিস্থিতির মিথ্যা বর্ণনা দিতে থাকলেন আর তার কান ভারী করতে থাকলেন। এখানকার পরিস্থিতিকে তিনি ভিন্নভাবে তুলে ধরলেন। ইয়াহিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে অভিযোগের ফিরিস্তি দেওয়া এক চিঠিতে বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের অনমনীয় মনোভাবের জন্য সমঝোতা সম্ভব হয়নি। চারদিকে খুন, অগ্নিসংযোগ ও রাষ্ট্রীয় আদেশ অমান্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। আমার শত চেষ্টা সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, তারা কোনো সমাধানে আসবে না। এমনকি শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত তারা যে প্রস্তাব দেয় তার অর্থ পাকিস্তানের দ্বিগুণ। ’

ইয়াহিয়া খান ওই চিঠিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে আরও লেখেন, ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার্থে আমাকে শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসছিল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। ৬ ডিভিশন সৈন্য সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করে। তারা আর্টিলারি ও প্যারাসুট ডিভিশন নিয়োজিত করে যার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যা আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি বিষয়গুলো বিবেচনা করে উপমহাদেশের শান্তি সংহত ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ভারতকে সংযত আচরণের জন্য ব্যবস্থা নেবেন। ’ 

বলা বাহুল্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে সর্বোতভাবে সাহায্য করার আশ্বাস দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৭
এমজেএফ/এইচএ/

আরও পড়ুন
** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।