ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

২৫ মার্চের গণহত্যার সাক্ষ্য দেন নিয়াজী

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
২৫ মার্চের গণহত্যার সাক্ষ্য দেন নিয়াজী ২৫ মার্চের গণহত্যার সাক্ষ্য দেন নিয়াজী

একাত্তরে বাঙালি নিধনযজ্ঞের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জুলিফকার আলী ভুট্টো-জেনারেল ইয়াহিয়া, আর তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ছিলেন টিক্কা খান-রাও ফরমান আলী। এই চারজনই ছিলেন ২৫ মার্চ গণহত্যার ধিকৃত খলনায়ক। এ সারিতে পরে যোগ দেন জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী।

ইতিহাস কখনো চাপা থাকে না। ক্ষমতার মোহে মত্ত ভুট্টো-ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে বাঙালিকে ‘দাবাইয়া’ রাখবেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষায় তারা বাঙালিকে ‘দাবাইয়া’ রাখতে পারেনি।
 
যুদ্ধ শেষ হলে‍া, ভুট্টো-ইয়াহিয়া-নিয়াজিরা মাথা নত করে বিদায় নিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গন থেকে। কিন্তু তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শেষ হয়নি। অগ্নিদগ্ধ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলেন। সেই দ্বন্দ্বের জের ধরেই শেষ পর্যন্ত ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে উঠতে হয়েছিল। বাকিদেরও করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। বাঙালি নিধনযজ্ঞের এই সব খলনায়কদের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্বের বর্ণনা পাওয়া যায় নিয়াজীর লেখা ‘The betrayal of East Pakistan’ বইয়ে।
 
পর্দার অন্তরালের সেই সব অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্রের কথা উঠে এসেছে নিয়াজীর লেখা বইটিতে। পাকিস্তানের শাসকচক্রের সেসব ষড়যন্ত্র, অন্তর্দ্বন্দ্বের আরও বর্ণনা পাওয়া যায় সিদ্দিক সালিকের ‘Witness to Pakistan’, জি ডব্লিউ চৌধুরীর ‘The last Days of United Pakistan’, হাসান জহিরের ‘The Separation of East Pakistan’  ও রাও ফরমান আলীর লেখা ‘Sar Gazisht’ বইয়ে। এসব বইয়ে একটি লক্ষ্যণীয়, তারা সবাই নিজের গা বাঁচিয়ে বা দায় এড়িয়ে অপরকে দায়ী করে একাত্তরের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।  

যেমন নিয়াজীর বই পড়লে আমরা ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা-ফরমান আলীর অপকর্মের কথা জানতে পারি, তেমনি ফরমান আলী বা সিদ্দিক সালিকের বই পড়লে ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা-ফরমান ও নিয়াজীর অপকর্মের কথা জানা যায়। ফলে, এদের সবার বই থেকেই আমরা তাদের সবার অপকর্ম ও গণহত্যায় তাদের ভূমিকা ও বাঙালি নিধনযজ্ঞে তাদের কর্ম-পরিকল্পনার কথা জানতে পারি। এভাবেই ইতিহাস তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।
 
টিক্কা খানের পরে মঞ্চে আসেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান নিয়াজী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তার নেতৃত্বেই পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হয়। কিন্তু ২৫ মার্চ তিনি দৃশ্যপটে ছিলেন না। ছিলেন টিক্কা খান ও অন্যরা। তার লেখা বইয়ে নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছে তার জন্য সে সময়ের সামরিক ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন। সেইসঙ্গে ২৫ মার্চ যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছে তাও অকপটে স্বীকার করেন এবং এর জন্য দায়ী করেন টিক্কা খানকে।  
 
তিনি বলেন, ‘সশস্ত্র বাঙালি ইউনিট ও ব্যক্তিবর্গকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতৃত্বকে গ্রেফতার করার জন্য টিক্কা খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টিক্কা এ দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেন’। তিনি আরও বলেন, ‘টিক্কা তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’। ’  

নিয়াজীর ভাষ্য মতে, টিক্কার নির্দেশ পালন করার জন্য পাকিস্তান সরকার মেজর জেনারেল রাও ফরমান ও ব্রিগেডিয়ার (পরে জেনারেল) জাহানজেব আরবাবকে নিয়োগ করেন। টিক্কার নির্দেশে রাও ফরমান আলীর পরিচালনায় সংঘটিত হয় ২৫ মার্চের গণহত্যা।
 
রাও ফরমান আলী তার একটি টেবিল ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেওয়া হবে (দি গ্রিন অব ইস্ট পাকিস্তান উইল হ্যাভ টু বি পেইনটেড রেড)। ’
 
সত্যি, পূর্ব পাকিস্তানের মাটি বাঙালির রক্তে সেদিন লাল হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালিরা গর্ভনর হাউস অবরোধ করার পর তারা ফরমান আলীর সেই ডায়েরিটি খুঁজে পায়। স্বাধীনতার পরে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ঢাকা সফরকালে ফরমানের এ ডায়েরিটি ভুট্টোকে দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭৪ সালের ২৮ জুন)।
 
নিয়াজী তার বইয়ে দাবি করেন, তার সঙ্গে সাক্ষাতৎকালে ফরমানের সে ডায়েরি সম্পর্কে নিয়াজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ভুট্টো। নিয়াজী তাকে জানিয়েছিলেন যে, ভারতে (যুদ্ধবন্দী) থাকাকালে তিনিও এ বিষয়টি শুনেছেন। তবে তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক বিষয়ে তার কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। এর মাধ্যমে ২৫ মার্চের গণহত্যার সঙ্গে ফরমানের সম্পৃক্ততা ও নির্দেশের কথা জানতে পারি।
 
নিয়াজী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মার্চ মধ্যবর্তী রাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। চারদিকে আর্তনাদ ও অগ্নিসংযোগ। জেনারেল টিক্কা তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যেন তিনি তার নিজের বিপথগামী লোকের সঙ্গে নয়; একটি শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ’
 
গণহত্যার রাতের পরে দিন (২৬ মার্চ) সকালে টিক্কা, ফরমান আলী ও আরবাবকে পিঠ চাপড়ে ভুট্টো অভিনন্দন জানান। তিনি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশ্বাস দেন। ভুট্টো তার কথা রেখেছিলেন। টিক্কা খান পাকিস্তানের চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, রাও ফরমান ফৌজি ফাউন্ডেশনে চেয়ারম্যান এবং ব্রিগেডিয়ার আরবাব প্রথমে মেজর জেনারেল ও পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন।
 
নিয়াজী বলেন, ২৫ মার্চের সেই সামরিক অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে যায়।
 
এভাবেই অপরাধী ও গণহত্যাকারীদের কাছ থেকেই বেরিয়ে আসে গণহত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা, নির্দেশনা, পরিকল্পনা ও ইন্ধনের কথা, ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হয় আপন মহিমায়।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
এইচএ/

আরও পড়ুন

** বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকার ও জনগণের বিপরীত অবস্থান
** ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ আগেই বুঝে যায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন
** নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’​
** ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।