ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে’ স্বাধীনতার রক্ত-কথন

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে”। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ এই সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় তিনি প্রধান অভিযুক্তদের অন্যতম।

গণহত্যার জন্য ভুট্টো-ইয়াহিয়া ছিলেন মাস্টারমাইন্ড আর সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন টিক্কা-রাও ফরমান আলীরা। এ কাতারে পরে যুক্ত হন নিয়াজী।

এরা সবাই ২৫ মার্চের গণহত্যা ও পরবর্তী অপরাধের জন্য দায়ী।

প্রকৃতপক্ষে রাও ফরমান আলী ছিলেন একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি। অনেকে বলতেন, ‘এত ভদ্র আর অমায়িক সৈনিক সারা পাকিস্তানে নেই’। বাইরে অত্যন্ত শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের এই সামরিক কমকতা ২৫ মার্চের গণহত্যার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। ফরমান আলী গভর্নরের দায়িত্ব পালন করতেন; থাকতেনও গভর্নর হাউজে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে তিনিই সব পরিকল্পনা করতেন।

মিথ্যাবাদী এই সেনাকর্মকর্তা যুদ্ধের প্রথম দিকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমরা একটি রক্ষাণাত্মক লড়াই করছি। এতে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হবে। তবে আমরা শত্রুদের শেষ করে দেব”।   পরে, বাঙালি-শত্রুদের শেষ করার জন্য তিনি সব চেষ্টাই করেন।

ফরমান আলী বাঙালি নিধন উৎসবের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘জেনারেল এই মুহূর্তে আপনার মানসিক অবস্থা কী রকম? যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে কি আপনি কি খুশি হয়েছেন? ফরমান আলী বললেন, ‘তা বলতে পারি না। তবে দিস ইজ এ গেম। যে কোনো গেমই একদিন শেষ হয়’। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ে ফরমান আলীর খেলাও শেষ হলো।

পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে করেছে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। রাও ফরমান আলী রাজাকার আলবদর বাহিনীর অন্যতম সমন্বয়ক ও নীতিনির্ধারক ছিলেন। ২৫ মার্চের গণহত্যার পরিকল্পনা করেছেন এই ফরমান আলী। ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের বর্ণনা থেকে সে কথা আমরা জানতে পারি। তাদের মধ্যে অন্যতম এএকে নিয়াজী ও আলতাফ গওহর। নিয়াজী মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। নিয়াজী তার বইয়ে ফরমান আলীকে একজন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন।

আলতাফ গওহর ছিলেন পাকিস্তানের আমলা। তিনি লিখেছেন- “তার (গওহরের) এক বন্ধু তাকে বলেন যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি (গওহেরর বন্ধু) বাঁচতে চান। এই বন্ধুটির নাম সানাউল হক। আলতাফ গওহর সানাউল হকের প্রাণ রক্ষার জন্য রাও ফরমান আলীর কাছে অনুরোধ করেন। রাও ফরমান আলী তার অনুরোধ শুনে ড্রয়ার থেকে একটি ডায়েরি বের করে সানাউল হকের নামটি কেটে দেন। সানাউল হক বেঁচে যান। ”

আলতাফ গওহর আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পর এই ডায়েরিটি পাওয়া যায়। এর পাতায় লেখা ছিল ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নামের তালিকা। এদের সবাইকে ১৪ ডিসেম্বর মেরে ফেলা হয়। রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ”

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত জেনে রাও ফরমান আলী পালানোর পথ খুঁজলেন। তিনি বারবার ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের হাইকমিশন ও জাতিসংঘের অফিসে তদবির করতে থাকেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।

চূড়ান্ত বিজয়ের দুই দিন আগেই (১৪ ডিসেম্বর) বাঙালি সেনারা ফরমান আলীর বাসভবন গভর্নর হাউজ দখল করে নেয়। সেখানে ওই ডায়েরিটি পাওয়া যায়। রাও ফরমান আলীর সেই টেবিল ডায়েরিতে লেখা ছিল, “পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে (দি গ্রিন অব ইস্ট পাকিস্তান উইল হ্যাভ টু বি পেইনটেড রেড”)।

সত্যি, পূর্ব পাকিস্তানের মাটি বাঙালির রক্তে সেদিন লাল হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ঢাকা সফরকালে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে ফরমানের এ ডায়েরিটি দেখিয়েছিলেন (১৯৭৪ সালের ২৮ জুন)।

নিয়াজী তার বইয়ে দাবি করেন, তার সঙ্গে সাক্ষাতৎকালে ভুট্টো এ ডায়েরি সম্পর্কে নিয়াজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। নিয়াজী তাকে জানিয়েছিলেন যে, ভারতে (যুদ্ধবন্দি) থাকাকালে তিনিও এ বিষয়টি শুনেছেন। তবে তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।

ফরমান আলী তার বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ রিপোর্টেও তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে বলা হয়। এমনকি নিজের লেখা বই ‘Sar Gazisht’-এও ফরমান আলী তার অপরাধ পুরোপুরি লুকাতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর ফরমানকে সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয় ও সকল ব্যাজ কেড়ে নেয়া হয়। জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর ফরমান আলী আত্মগোপনে চলে যান।

আরও পড়ুন
** কসাই টিক্কার নির্দেশ, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’
** ২৫ মার্চের গণহত্যার সাক্ষ্য দেন নিয়াজী
** বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকার ও জনগণের বিপরীত অবস্থান

** ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ আগেই বুঝে যায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন
** নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’​
** ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা


বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।