দু এক সপ্তাহ আগে ভারতের পেট্রাপোলে এক অনুষ্ঠানে মমতার সংগে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক মঞ্চে বসেছিলেন। ছবিটা দেখে মনমোহনের সফর নিয়ে বেশ আশ্বান্বিত ছিলাম।
ছোট বেলায় দেখেছি আমার দূর সম্পর্কের দুই দাদী যারা একে অপরের সই (বন্ধু) ছিলেন তারা দুজন এক হলে ঠিক এভাবেই বসে বন্ধুত্বের সময়টুকু পার করতেন। কি নির্মল বন্ধুত্ব ছিল তাদের মধ্যে! মূলত সে কারণেই ইতিবাচক ভাবনাটা মনে এসেছিল। ভেবেছিলাম ভারত বোধহয় প্রতিবেশীদের বঞ্চিত করার মানসিকতা থেকে সরে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মমতাই তার বন্ধুত্বের মমতার বন্ধন থেকে সরে এসে ঠিক বুকের মাঝখানটাতে যেখানে ভালবাসার পরিচালক (হৃদয়) বসে থাকেন সেই বরাবর ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।
কি হলো এতো টাকা খরচ করে এতো আয়োজনে? এই টাকা বরং রাস্তা নির্মাণে ব্যয় করলে আমাদের সড়ক নিরাপত্তার কিছু উন্নয়ন ঘটতো। শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল বড় মাছ দেখিয়ে রাত্রিযাপন করে আসলে ওনারা এসেছিলেন পুকুর চুরি করতে।
এটা কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না যে কোনও হোম্ওয়ার্ক ছাড়া ভারতের মতো কুটনীতিতে ঝানু একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী সফরে যাচ্ছেন। প্রথমে আশা জাগানো এবং বিনিময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ট্রানজিটের ব্যপারে আশ্বাস পাওয়া, এরপরে কোনও এক যুক্তিতে সরে গিয়ে নিজেরটা নিয়ে সটকে পড়া- এটাই তাদের কূটনৈতিক চাল ছিল কিনা ইচ্ছে হলেও অবিশ্বাস করতে পারছি না। এতো বড় একটা চুক্তি হবে সেখানে মনমোহনের মতো একজন বিজ্ঞ লোক কিভাবে মমতার সংগে সমাঝোতা না করে এলেন সেটা ভাবতে কষ্ট হয়।
তারা যে মনমোহনের মতো ভারতের বড় নেতাকে দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে ট্রানজিটের মতো বিশাল একটা কিছু পাবার ধান্দায় ছিল মনে করলে দোষের কি? রাষ্ট্নায়কের কোনও দেশে বেড়ানো তো বোনকে দেখতে যাওয়া নয় যে শুধু আবেগই উদ্দেশ্য। এখানে কিছু বাস্তব ফলাফল থাকতে হবে। এই নিস্ফলা অমিতব্যয়ী আয়োজনের হেতু কি? আসলে ওনারা নিতে চেয়েছিলেন অনেক কিছুই, দিতে চাননি কিছুই।
যে মমতাকে আমরা এতো বন্ধু ভেবেছিলাম সেই মমতাই তিস্তা চুক্তির কফিনে শেষ পেরেকটা বসিয়ে দিয়ে আবারো প্রমাণ করলেন ওরা আমাদের নিঃশর্ত বন্ধু হতে পারে না। মমতা যতোই সাহারা আপাকে কাছে টেনে ভাল ভাল কথা বলুন না কেন ওর ভিতর যে ভালবাসা কিংবা মমতার কোনও ছোয়া ছিল না সেটা আমাদের সাহারা আপারা বুঝলে হয়তো বলতেন:
আমার কথায় যতোই তুমি
দাওনা শত তালি
তোমার সকল মিষ্টি কথার
মধ্যে ছিল গালি। ।
ব্যক্তির সংগে ব্যক্তির সম্পর্ক আবেগনির্ভর হতে পারে। সেখানে লাভক্ষতির যা কিছুই ঘটুক শুধু ঐ ব্যক্তিকে ঘিরেই হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হতে হয় পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর। ‘ভাল সম্পক’ কখনো মাত্র একটা ঘটনা ভিত্তিক হতে পারে না, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, একটা চলমান সমতাভিত্তিক দেওয়া- নেয়ার সম্পর্ক। একাত্তর সালের পরে আমরা সেই সমতাভিত্তিক দেওয়া-নেওয়ায় কতোটুকু নিতে পেরেছি সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়াও একাত্তরের সাহায্যটাও চানক্য-নীতির আলোকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে সেটা আমরা ভুলে যাই। চানক্য বলেছিলেন, ‘সকল বন্ধুত্বের সম্পর্কের ভিতরে একটা চাওয়া পাওয়ার হিস্যা থাকে। এটা ছাড়া কোন বন্ধুত্ব হতে পারে না। ’
সেকারণেই যুদ্ধ পরবর্তীতে আমরা দেখেছি পাকিস্তানি হানাদারদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র সারি সারি ভারতীয় ট্রাকে করে নিয়ে যেতে। যুদ্ধক্লান্ত একটা অসহায় রাষ্ট্রকে এভাবে বিপদে ফেলে রাখা, তাদের প্রাপ্য সম্পদ নিয়ে চলে যাওয়া কোন ধরনের বন্ধুত্ব? তাছাড়া পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ে তারা ওদের কাছ থেকে কি কি সুযোগ সুবিধা নিয়েছিল তার আমরা কতোটুকু জানি। এগুলো ভুলে গিয়ে কূটনৈতিক দরকষাকষিতে যেখানে নিজের অবদান/অবস্থানকে তুলে ধরা প্রয়োজন সেখানে বারবার অতি কৃতজ্ঞতায় আমরা ভারতীয়দের হয়ে ওদের যুক্তিটা দিয়ে দরকষাকষিতে তাদেরকে সুবিধাজনক স্থানে বসিয়ে দেই।
আমাদের গওহর রিজভীদের কথা শুনে ভুল হয় উনারা কার প্রতিনিধি; ভারত নাকি বাংলাদেশের? যার জীবনের বেশীরভাগ কেটেছে ভারত না হয় বিলেতে সে কী করে বুঝবে এ দেশের স্বার্থ! এ ধরনের লোকেরা থাকলে ভারতের কাছ থেকে আমরা এর চেয়ে বেশি কি আশা করতে পারি? ধন্যবাদ নিউজ মিডিয়াগুলোকে। এবার তারা অত্যন্ত সতর্ক ছিল বিধায় প্রকাশ্যে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনও চুক্তি করতে পারেনি।
মনমোহনের সফরকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক বিশ্লেষণধর্মী লেখা পড়লাম। কিন্তু একটা কথা সবার নজর এড়িয়ে গেছে। এই ফ্যান্টাসি সফরের মধ্য দিয়ে নিরবে নিভৃতে কি ঘটেছে কিংবা ঘটতে পারে! নিরাপত্তার নামে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতা ছিল অনেকটা দৃষ্টিকটু। এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা নেই। এর মাধ্যমে তারা আমাদের সামর্থ্যকে খাটো করে দেখেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় কি এমনটা করতে পেরেছিল বাংলাদেশের গোয়েন্দাকর্মীরা? ভারতীয় গোয়েন্দাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আসলে কি শুধু মনমোহনের নিরাপত্তাজনিত ব্যাপার ছিল নাকি থলের ভিতরে কোন হুলো বেড়াল লুকানো ছিল! আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার তথ্য কি পরিমাণে পাচার হলো ভবিষ্যতে উইকিলিকসের মাধ্যমে হয়তো তা জানা যাবে। অবশ্য গওহর রিজভীর মতো দেশপ্রেমিক (!!!) লোক থাকতে জাতীয় নিরপত্তার তথ্য পাচারে বাইরের গোয়েন্দাদের খুব বেশি দরকার পড়ে না।
এই সফরে বিরোধী দলের এখন পর্যন্ত ভূমিকা সাধুবাদ পাবার যোগ্য। অহেতুক ভারত বিরোধী জঙ্গীভাব যে ভাল নয় সেটা বুঝতে পারলে মঙ্গল। কেউ কেউ অতি লাঠিয়ালের মতো বলা শুরু করেছিল মনমোহনের সফরের সময় কালো পতাকা দেখিয়ে হরতাল ডাকা হবে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মতি না থাকায় তারা তা করতে পারেনি বরং দল থেকে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। রোজার আগে করা একটা প্রতিজ্ঞা, আমরা আর গণবিরোধী হরতাল করবো না এবং মনমোহনের সফরকে ভালভাবে নেওয়া রাজনীতিতে দুটো শুভ লক্ষণ বলে আপাতত মনে হচ্ছে।
এই ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে প্রধান বিরোধী দলকে আরো কয়েকটি ভাল সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলোকে পাশে রেখে কখনো ভাল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আগাতে গেলে সব সময় এরা জামার হাতা টেনে ধরবে। দেশের মানুষের কাছে এদের অবস্থান কি সেটাতো সংসদে দুই সিট পাওয়া ফলাফলের খাতা খুললেই বোঝা যায়। একাত্তর সাল থেকে এরা শিক্ষা নেয়নি। তাদের বেঈমানীর নজির তো প্রধান বিরোধী দল বিগত নির্বাচনে দেখল। এই দেশবিরোধী শক্তি নিজের স্বার্থেই যা কিছু করে। তাই সংবিধান না ছুড়ে এদের সঙ্গ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে হবে।
আরেকটি উদারতা প্রধান বিরোধী দলের কাছ থেকে জনগণ আশা করে। যে কারণে কিংবা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন বর্তমান সরকার যে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পেরেছে ‘তিস্তা না হলে ট্রানজিট নয়’ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সরকারকে এ জন্য সাধুবাদ জানানো উচিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে; কিন্তু সেটা হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্মান বজায় রেখে।
ফিরে আসি আগের কথায়। মনমোহনের বত্রিশ ঘন্টার ফ্যান্টাসি সফর পয়ষট্টি দফা মুখ রক্ষার ইশতেহারের মাধ্যমে শেষ হলো। এবারের শীর্ষ বৈঠকে বেশ জোরে শোরে উচ্চারিত হচ্ছিল যে, দু পক্ষই একশো ভাগ হালাল সাবানের মতো একশো ভাগ আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা নিয়ে আসছে। তাই ইতিবাচক ফলাফল অনিবার্য। ফলাফল পেলাম বটে তবে সেটা দু পক্ষের একশো + একশো = শুন্য। অনেকটাই দিল্লিকা লাড্ডুর মতো। সকলই ভুয়া.. সকলই ফক্কিকার!
এবার প্রাসঙ্গিক অন্য বিষয়। মনমোহন বাংলাদেশ ছাড়তে না ছাড়তে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল ভারতে দিল্লির হাইকোর্টে। উগ্রপন্থীদের আক্রমণে আরেকবার পর্যুদস্ত হোল ভারত। জঙ্গীবাদ শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বে এই মুহুর্তে একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সু সম্পর্ক থাকা জরুরি। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিবেশী কোন দেশের সঙ্গে ভারত সেই সম্পর্ক রাখতে পারেনি। সম্পর্ক নির্ণয় হয় কাজে, কথায় নয়। ভারত বাংলাদেশের চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সম্পর্কের ঘরেও দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। সেখানে ফালানীদের লাশের মতো ভারত-বাঙলাদেশের বন্ধুত্বও অবিশ্বাসের সূতোয় লটকে গেছে। এমনি করে প্রতিটা প্রতিবেশীর সঙ্গে রয়েছে ভারতের অবিশ্বাসের সম্পর্ক। দূরবর্তী কিছু দেশ ছাড়া প্রতিবেশী একটা দেশের সংগেও ভারতের ভাল সম্পর্ক নেই। বড় দেশ হিসেবে প্রতিবেশীর কাছে শুধু পেতে চাইলেই হবে না, তাদেরকেও কিছু দিতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদের মতো আরেকটা প্রধান সমস্যা হচ্ছে পানি। কেউ কেউ বলেন, পরবর্তীতে কোন বিশ্বযুদ্ধ হলে সেটা হবে পানি নিয়ে। মাউড বারলো নামের একজন ক্যানাডিয়ান মনীষী বলেছেন, ‘... water has become the blue gold of the 21st century, a precious commodity that will determine the fate of nations and societies.’
কথাটার তাৎপর্য আমরা না বুঝলেও মমতারা বুঝেছেন ঠিকই। তবে এখনো আমরা আশাবাদী পানি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোন তিক্ততা নয়। বরং পানির অপর নাম যেমন জীবন, তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মৃতপ্রায় সম্পর্ক আবারো প্রাণ ফিরে পাবে।
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১২২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১১