ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলা নববর্ষ এবং মাজদা গাড়ি কি ইসলাম সম্মত?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
বাংলা নববর্ষ এবং মাজদা গাড়ি কি ইসলাম সম্মত? বাংলা নববর্ষ এবং মাজদা গাড়ি কি ইসলাম সম্মত?

একজন ধার্মিক মুসলিম ভাই আমাকে বাংলা নববর্ষ যে হিন্দুয়ানি, তা নিয়ে এক বিরাট বয়ান দিলেন। তার বয়ানের মোদ্দাকথা, মুসলিমরা এসব রীতি পালন করতে পারে না। ইসলামে এসবের কোনো স্থান নেই। আমি মুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনলাম। কী আর করা! তিনি আমার মুরুব্বি; কী বলবো, কীভাবে বলা যায়?

মনে মনে তাই ভাবছি। ব্যাপারটা মোটেও সহজ হবে না।

তিনি কথা বলার সময় কোনো সুযোগ রাখেন না; অন্য কাউকে কথা বলার কোনো রকম সুযোগ দেন না। কেউ কিছু বলতে চাইলে প্রধান শিক্ষকের মতো বলেন, ‘কথার মধ্যে কথা বলবে না’। হঠাৎ আমার মনে হলো, মুরালিধরনের মতো আনকণভেশনাল স্টাইলে বল করতে হবে; দেখা যাক, মুরুব্বি কি করেন? অনেকটা উদ্ভট এবং অপ্রাঙ্গিকভাবেই জিজ্ঞেস করলাম,
-ভাইয়া কি কিছু দিন আগে নতুন গাড়ি কিনেছেন?
-হু, কিন্তু তুমি এরকম একটি কথার মধ্যে গাড়ি নিয়ে এলে কেন? তোমরা না কিছুই শেখনি; জরুরি কথার মধ্যে উল্টা-পাল্টা কথা বলো... যত্তসব...(ধমকের স্বরে বললেন)।    
-না, ভাইয়া...প্লিজ... কিছু মনে করবেন না... আপনার গাড়িটা সুন্দর তো, সেভেন সিটার... মাজদা... তাই না?
-হু, সেভেন সিটার...মাজদা...
-আপনি তো অনেক পড়াশুনা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অনেক কিছু জানেন। মাজদা গাড়ির নামকরণ সম্পর্কে কিছু বলবেন?  

-মাজদা...মাজদা মোটামুটি ভালো গাড়ি; ফ্যামিলিতে লোকজন বেড়েছে তো...বোঝো না...ছোট গাড়িতে এখন আর হয় না, তাই একটা ফোর হুইল সেভেন সিটারই কিনলাম...

-জ্বি ভাইয়া...জ্বি...আমি ফের জানতে চেয়েছিলাম ‘মাজদা’ নাম সম্পর্কে...

-মাজদা...মাজদা...নামের ইতিহাস...আচ্ছা তুমি এরকম উদ্ভট প্রশ্ন কই পাও? এরকম প্রশ্ন তো আমার মাথায় কোনো দিন আসেনি...৫৬ হাজার ডলার খরচ করে একটা ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি কিনে ফেল্লাম...কিন্তু একবারের জন্য এই প্রশ্নটি মাথায় আসেনি...কিন্তু তোমার এটা জানার জন্য এতো কৌতুহল কেন?  
-আমি অহেতুক চিন্তা পরিষদ করি তো...
-কী পরিষদ?

-অহেতুক চিন্তা পরিষদ
-ও আচ্ছা...তোমাদের কাজ-কর্ম-কথা-বার্তার যদি কোনো আগা-মাথা থাকতো...এটা নাস্তিকদের কোনো সংগঠন নাকি?

-না, ভাইয়া...অহেতুক চিন্তা পরিষদের সঙ্গে আস্তিক-নাস্তিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। এরা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ-স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে। অনেকটা সুফিবাদী কিংবা আধ্যাত্মিক লাইনের ‘স্কুল অব থটস’ বলতে পারেন। আমরা আধ্যাত্মবাদ নিয়ে যতটা সম্ভব পড়াশুনা করি। তবে আমি আপনাকে ‘মাজদা’ নামের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা বলতে পারবো...

-বলো...শুনি...এর মধ্যে আবার আধ্যাত্মিক কিছু খুঁজে পেলে নাকি?

-কিছুটা তো আছেই... আনুমানিক ৬২৮ থেকে ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বে পারস্যে (বর্তমান ইরানে) জন্মলাভ করা পয়গম্বর জরথুস্ত্র (জরোয়াস্টার, Zoroaster) শয়তানের ধারণাটিকে আরেকটু স্বচ্ছ অবয়ব দান করার চেষ্টা করেন।

-তুমি আবার কিসের মধ্যে কী নিয়ে আসলা? মাজদা নামের সাথে শয়তানের অবয়ব খুঁজে পেয়েছ? ফালতু কথা বলে আমার টাইম নষ্ট করো না তো...
-না, ভাইয়া। একটু শুনুন...

-আচ্ছা বলো...(ছোটখাটো একটা হাই তুলতে তুলতে তিনি বললেন)।

-তার প্রচারিত মতবাদটি পরিচিতি পায় মাজদাবাদ (Mazdaism) নামে। তিনি তার প্রচারিত ধর্মে আধাত্মিকতাবাদে অনেক নতুন ধারা সংযোজন করেন।
-আচ্ছা! মাজদাইজম! এতো দেখি মহানবীর (সা.) জন্মের প্রায় ১১০০ বছর পূর্বের ইতিহাস... তারপর?

-ধর্মীয় ইতিহাসে প্রথম একঈশ্বরবাদী ধর্মের প্রবক্তা হিসাবেও তাকে বিবেচনা করেন ইতিহাসবিদরা। তৎকালীন সমাজের দেবতা বরুণ, মিত্রা ও ইন্দ্রকে পূজা বাদ দিয়ে, এসবের পরিবর্তে জরথুস্ত্র (জরোয়াস্টা) শুরু করেন তার সৃষ্ট সর্ব ক্ষমতার অধিকারী, স্বর্গ-মর্ত্যের সৃষ্টিকারী আহুরা মাজদা (Ahura Mazda) নামে এক শুভ পুরুষ দেবতার পূজা/প্রার্থনা।
 
-আহুরা মাজদা?  
-হু, আহুরা মাজদা...

-জরথুস্ত্রর মতে আহুরা মাজদার জমজ ভাই হলো আহরিমান (Ahriman)। যিনি হলেন, মন্দের দেবতা। পৃথিবীতে যতো খারাপ আছে, সব কিছুর স্রষ্টা এই আহরিমান। এই আহরিমানই হচ্ছে শয়তান।

-আহুরা মাজদা এবং আহরিমান যমজ ভাই?
-হু, যমজ ভাই... আহুরা মাজদা ও আহরিমানের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব প্রতিষ্ঠায় শুরু হয় বিরোধ। বিরোধ গড়ায় যুদ্ধে। জরোয়াস্টানরা বিশ্বাস করতেন, তাদের এই যুদ্ধ ক্রমাগত চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত খারাপ দেবতা আহরিমান পরাজিত না হয়। মাজদাবাদে শেষ বিচার নামে এক বিচার ব্যবস্থার (হাশর) উল্লেখ আছে, যেখানে মৃত মানুষদের আত্মাকে কর্ম অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করা হবে। যারা ভালো কাজ করবে তাদের প্রাপ্তি স্বর্গ, আর যারা খারাপ কাজ করবে তারা ভোগ করবে অনন্তকাল নরক যন্ত্রণা ।
      
-এটা তো অনেকটা একঈশ্বরবাদী ধর্মের মতো...
-হু। ইতিহাসবিদদের মতে ‘মাজদাবাদ/জরাস্টানিজম’র ধারাবাহিকতাই পরবর্তীতে অন্যান্য সেমেটিক ধর্মের তথা একঈশ্বরবাদী (ইহুদি, খ্রিস্টান ইত্যাদি) ধর্মের জন্ম।    
-আচ্ছা...
 
-এখন বলেন, আপনি একজন ধার্মিক মুসলিম হয়ে ‘মাজদা’ গাড়ি ব্যবহার করবেন? মাজদা গাড়ির সামনে যে লগো/প্রতীক থাকে তা কিন্তু ওই আহুরা মাজদা দেবতার প্রতীক। আপনারা যেহেতু ভাস্কর্যকে মূর্তি বলেন, হাইকোর্টের সামনে ন্যায় বিচারের প্রতীক থেমিসের ভাস্কর্যকে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছেন, সেহেতু আপনি কিন্তু মূর্তির প্রতীকযুক্ত গাড়িতে চলাফেরা করতে পারেন না।
 
-কেন করবো না? তুমি কিসের সাথে কি মিশিয়ে ফেল্লা? এখানে গাড়ি ব্যবহারে মুসলিমদের সমস্যা কোথায়? সৌদি আরবের মানুষ কি মাজদা গাড়ি চালায় না? আমি হজে গিয়ে সৌদিতে অনেক মাজদা গাড়ি দেখেছি। তুমি কি বলতে চাও? আমি এখন আমার নতুন গাড়িটি চেঞ্জ করে ফেলবো?

-না, আমি তা বলছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি গাড়ি ব্যবহারে সমস্যা না থাকলে বাংলা পঞ্জিকা ব্যবহারে সমস্যা কোথায়?
 
-তুমি তো ভুল যুক্তি দিচ্ছো... ফালতু...
-আমার যুক্তি ভুল নয়, আপনি নিজেও তা জানেন...আচ্ছা...আপনি হজে গিয়েছিলেন প্লেনে? নাকি জাহাজে?
-কি প্রশ্ন করছো? এখন কি জাহাজে চড়ে কেউ হজে যায়?
-বুঝলাম, প্লেনে চড়ে হজে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ইহুদি-নাসারা-খ্রিস্টানের তৈরি প্লেনে চড়ে হজে গিয়েছিলেন কেন?
-ইহুদি-নাসারা-খ্রিস্টানরা প্লেন বানিয়েছে তো কী হইছে? আল্লাহর হুকুম ছাড়া কি তারা বানাতে পারতো?  
-মানে... মানে?

-আর ‘মানে’ ‘মানে’ করবা না। আর একটা কথাও বলবা না...এতক্ষণ অনেক বকবক করছো...আগে শোনো, আমি কি বলি? জ্ঞান-বিজ্ঞান হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহর নেয়ামতের ওপর সবার অধিকার আছে...আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই সৃষ্টি হয়নি...এটা বোঝো?
 
-যদি তাই হয়, তাহলে বাংলা পঞ্জিকা, পহেলা বৈশাখে... আপনাদের এতো অসুবিধা কেন? এসব কি আল্লাহর হুকুম ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে? বাংলা পঞ্জিকাও তো আল্লাহর নেয়ামত।
 
মুরুব্বি আমার দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টি দিলেন। কিন্তু আর কথা বাড়ালেন না। হাসিমুখে আমি তাকে ‘শুভ নববর্ষ’ বললাম; তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলতে বলতে চলে গেলেন...

বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।