ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের অপচেষ্টা কেন!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৭
বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের অপচেষ্টা কেন! প্রতীকী ছবি

ঢাকা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা বহিরাগতদের উৎপাতের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ভিন্ন এক কৌশলে। নিজেদের তৈরি ভাস্কর্যগুলোকে নিজেরাই উল্টে রেখে রেখেছিলেন তারা।

কিন্তু তার আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও শুরু হয়ে গিয়েছিলো উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার। হায় হায় করে উঠেছিলো একটি পক্ষ।

বাংলাদেশে আর ভাস্কর্য রাখা হবে না, পুরো দেশ আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে, এমন ভাব নিয়ে শুরু হয়েছিলো প্রচারণা।

তবে দিন গড়ানোর আগেই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে জল ঢেলে দিয়েছিলেন ‍অপপ্রচারক‍ারীদের মুখে। কিন্তু তারা  নিজেরাই নিজেদের ভাস্কর্য উল্টিয়ে রাখার ঘটনা জানালেও অপপ্রচার পুরোপুরি থামানো সম্ভব হয়নি। নীরব প্রতিবাদের শান্তিপূর্ণ প্রকাশকে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন হিসেবে প্রমাণের একগুঁয়ে প্রচেষ্টা তারপরও চলেছে।

এভাবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে এই রাষ্ট্রকে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রমাণের একটি জোরালো চেষ্টা লক্ষ করা যায়।

সর্বশেষ উপন্যাসিক কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে এএফপি'তে প্রকাশিত প্রতিবেদনও তো বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক শরীরে ওই সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি সাঁটিয়ে দেওয়ার ‍অপচেষ্টা। যিনি প্রেমিকাকে বোরকা পরিয়ে ডেটিংয়ে পাঠান তার লেখা পড়ে তাবৎ বিশ্বের বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের ‘ধর্মগুরু’ আখ্যা দেওয়া কিছু মিডিয়ায় কাশেমকে নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণ বুঝতে কষ্ট হয় না।

কার্যত বাংলাদেশে কিশোরদের কাছে জনপ্রিয় বইয়ের তালিকায় রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা আর কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা এখনো সবার উপরেই আছে। তার আগে কাজী আনোয়ার হোসেনেরই কুয়াশা সিরিজ, রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর শাসন করেছে পাঠকের মন-মেজাজ। বুক স্টল থেকে শুরু করে ফুটপাত পর্যন্ত এখনো পেপারব্যাক ওয়েস্টার্ন আর সায়েন্স ফিকশনেরই দাপট। আর কিংবদন্তী হুমাযূন আহমেদ তো রয়েছেনই।

গত বই মেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বই বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যায়। তবে বইয়ের এই বিক্রি নিয়ে কোন প্রতিবেদন আসেনি কোন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।

তাহলে কাশেম বিন আবু বকরকে নিয়ে কেন এতো বাড়াবাড়ি! সত্তর দশকের এই লেখককে কখনো কেউ মূলধারায় দেখেইনি। সাহিত্যের মানদণ্ডেও উতরাতে ব্যর্থ তার যে কোনো লেখা। ফুটন্ত গোলাপ ছাড়া তার আর কোনো বইয়ের নাম গত ক’দিনে কেউ বলতে পারেনি স্যোসাল বা নিউজ মিডিয়ায়।

তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তরুণ-তরুণীদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করাতে উপন্যাস লিখতেন তিনি। তার লেখার উপাদানও ছিল ইসলাম। এমন একজন লেখককে নিয়ে হইচই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। ধর্মের প্রতি দুর্বলতা থেকে বাংলাদেশিদের কাশেম-বিন আবু ব‍াকারের প্রতি ঝোঁকার বিষয়টিই প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে বিতর্কিত মিডিয়ায়। মোটেও তাকে ঔপন্যাসিক হিসেবে জনপ্রিয় করার প্রয়াস চালানো হয়নি। কিন্তু কোনো প্রতিবেদন না পড়েই এক শ্রেণির মানুষ বিদেশি মিডিয়ার গালিকে প্রশংসা হিসেবে নিয়ে লাগামহীন মাতামাতি শুরু করেছেন।  

এবার একটু অতীতে ফিরে যাই। পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ক্যান্টিনে খাসির মাংসের স্থলে গরুর মাংস খাওয়ানো নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে। কৌশলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের গরুর মাংস খাওয়ানোর অভিযোগে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে এই প্রতারণায় নৈতিক দিক থেকে সমাজের অবক্ষয় যতোটা চিহ্নিত হয়, ততটাই সাম্প্রদায়িক হিসেবে রাষ্ট্রের ওপর অভিযোগ আসতে থাকে।

তবে দিন না ঘুরতেই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। চারুকলার ক্যান্টিনে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কিছু সদস্য নিজেদের 'ফ্রি' খাওয়াকে বৈধতা দিতে এই কাণ্ড ঘটান। প্লট সাজিয়ে ক্যান্টিন মালিককে উৎখাত করেন এবং তার বকেয়া টাকা মেরে দেন।  

এই বাংলাদেশ মৌলবাদী নয়। এখানে ধর্মপ্রাণ মুসলমান রয়েছে, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তার প্রমাণ এই জাতি যেমন ১৯৫২ সালে উর্দু ভাষাকে বিতাড়িত করে প্রমাণ করেছে, তেমনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক রাষ্ট্র ভেঙ্গে ভাষা ও জাতির উপাদানে নতুন দেশের জন্ম দিয়েছে।

ইউরোপ থেকে শুরু করে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া কোথাও পাওয়া যাবে না, যেখানে উগ্রবাদি গোষ্ঠী নেই। তবে সেই গোষ্ঠী কোনদিনই দেশটির পরিচয় বহন করে না।

সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেকে গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রগতিশীলরা। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ জনগণের মতোই জানতে চেয়েছেন, সেখানে এই ভাস্কর্য প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কেন! যা এই দেশের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত নয়।

ভার্স্কয সরানোর হেফাজতে ইসলামের এই দাবির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী সায় দেয়ার পর থেকেই একটি গোষ্ঠী চীৎকার করে বলতে থাকেন, বাংলাদেশে আর কোন ভাস্কর্য রাখা হবে না। অথচ এই বিমানবন্দর সড়কেই গড়ে উঠছে মুক্তিযুদ্ধের উপর দেশের সর্বোচ্চ ভাস্কর্য 'বীর'।

এই বাংলাদেশে 'বীর'রা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেই। পতন হবে সব সাম্প্রদায়িক শক্তির। তবে দেশকে যে গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রমাণ করতে চাচ্ছে, তাদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে সবাইকেই।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৭
এমএন/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।