বাংলাদেশে যখন প্রথম প্রথম কম্পিউটার বিভিন্ন অফিসে ব্যবহার হতে থাকে সেই নব্বই এর দশকের শুরুতে সেসময় কম্পিউটারের ভাইরাসকে নিয়ে বেশ একটা অদ্ভুত আচরণ ছিল কম্পিউটার অপারেটরদের মধ্যে।
এখনকার মতো তখন সবাই কম বেশি কম্পিউটার জানতো না।
এ সবই করা হতো কম্পিউটারের ভাইরাস ঠেকানোর জন্য। কি হাস্যকর আচরণ ছিল এখন ভাবলে বেশ মজা লাগে। মানবদেহের ভাইরাসের মতো কম্পিউটার ভাইরাস যে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে ঢোকার ক্ষমতা রাখে না সে কথা কে জানতো! আমরা আমজনতা হয়তো জ্ঞানের অভাবে নাই জানতে পারি। কিন্তু তখন যারা কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ছিল তারা কিন্তু ঠিকই জানতো। তারপরেও একটা অবিশ্বাস্য পবিত্রতার মিথ তৈরি করে তারা নিজেদের অফিসের আর সব সহকর্মীর থেকে একটু উপরের শ্রেণীর বাড়তি মর্যাদা পাবার চেষ্টা করতো। এর মাধ্যমে তারা আরো কিছু অযাচিত সুবিধা নিত। যেমন: অফিসের সবাই গণ রুম ব্যবহার করলেও কম্পিউটারের সুবাদে তাদের জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা ছিল। সবাই গরমে ঘামে কাকভেজা হয়ে কিংবা শীতে নবুথবু হয়ে কাজ করলেও ভাইরাস জুজুর ভয় দেখিয়ে শীত গরমের কষ্ট থেকে রেহাই পেত কম্পিউটার বিভাগ। এবং কম্পিউটার সম্পর্কে একটা পবিত্রতার মিথ তৈরি করে যন্ত্রটার পাশাপাশি যারা এটার ব্যবহারকারী সেই বিশেষ জ্ঞান জানা সম্প্রদায়ের বিশেষ একটা জাতের ওঠার অপচেষ্টা ছিল। অবশ্য এই পবিত্রতার মিথ বেশিদিন টেকেনি। মানুষ যতো দ্রুত সচেতন হয়েছে ততোই কম্পিউটারকেন্দ্রিক জাতপাতের ব্যবস্থা উঠে গেছে।
ঠিক একই কায়দায় আমাদের দেশে কিছু কিছু পেশাকে এমন একটা উচ্চতর জাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে তাদের সম্পর্কে কিছু বলা মানে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাওয়া। বিরোধী দলীয় নেত্রী কিছুদিন আগে উচ্চতর আদালতের এক সাবেক বিচারক সম্পর্কে ঘুষ বিষয়ক মন্তব্য করেছিলেন। সেই জের ধরে ইদানিং কোন কোনও মহল থেকে গলা ফাটানো হচ্ছে তিনি নাকি আদালতের অবমাননা করেছেন। কিন্তু আদালত আর বিচারক যে এক নয় সেটা তাদের কে বোঝাবে। কেউ আদালতের সুযোগ নিয়ে যদি অপকর্ম করে তবে কি সে রেহাই পেতে পারে? বরং অপকর্মের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি নিজেই তো আদালতকে অবমাননা করলেন।
পত্রিকায় দেখলাম আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, খালেদা জিয়া বিচারপতি খায়রুলকে নিয়ে ঘুষ বিষয়ক যে মন্তব্য করেছেন সেটা আদালত অবমাননার সামিল। রাজনৈতিক বিতর্ক বাড়ানো ছাড়া এই ধরনের বাহাস আর কোন কাজে আসে না। যদি খালেদার বক্তব্য সঠিক না হয় তার জন্য তো অন্য আইনি ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে। ঐ বিচারপতি ইচ্ছে করলেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে দিতে পারেন প্রকাশ্যে মিথ্যা বিবৃতি দেবার জন্য। তা না করে আদালত অবমাননার ধুয়া তুলে শর্ট কাটে গিয়ে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তো জনমনে খালেদা জিয়ার বক্তব্য কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
তাছাড়া বিচারপতি হবার সুযোগে তিনি কেন আর দশ জন সাধারণ নাগরিকের মতো মানহানির মামলার মতো গ্রহণযোগ্য আইনি আশ্রয় না নিয়ে পুরো আদালততে জড়িয়ে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন? এটা বেআইনী না হলেও অনৈতিক নয় কি! বিচারপতি খায়রুল মানেই কি আদালত? অবশ্যই নয়। কোন একজন বিচারপতির কর্মকান্ডের দায়ভার আদালতের ঘাড়ে চাপানো ন্যক্করজনক কাজ।
প্রসঙ্গক্রমে আরো একটা বিষয় আলোচনার দাবি রাখে; যদিও একটা খারাপ কাজকে পূর্বের অনুরূপ কাজের উদাহরণের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করাকে আমি ঘৃণা করি। তবুও আইনমন্ত্রীর বর্তমানে আইনের প্রতি অতি শ্রদ্ধা দেখে তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তিনি তখন কোথায় ছিলেন যখন একজন উকিল আদালতের দরজায় লাথি মেরে পরবর্তী সময়ে বিচারপতি হয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলেন? কিংবা আদালতের বিরুদ্ধে লগি-বৈঠা মিছিল করে আদালত চত্বরকে বস্তি বানিয়েছিলেন? দুটো ঘটনাইতো ছিল আদালতকেন্দ্রিক অবমাননা। দেরিতে হলেও তো অপরাধের বিচার করা সম্ভব। তিনি কি ওইসব অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করবেন?
গত ৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ কোলকাতার আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে একটা লেখা ছেপেছে আদালত বিষয়ে। লেখার শুরুটা ছিল এ রকম “অভিনব বটে। আবার জরুরিও। যাঁহাদের উপর ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা নির্ভর করিয়া থাকে, বিচক্ষণতা যাঁহাদের কাজের মূল ভিত্তি, তাঁহাদের আচরণবিধি নির্ধারণের নিমিত্ত লোকসভায় একটি বিল প্রস্তাব করা হইয়াছে। বিচারব্যবস্থার মাপকাঠি এবং দায়বদ্ধতা সম্পর্কিত বিলটির মূল বক্তব্য বিচারকরা কোনও অবস্থাতেই যেন তাঁহাদের কাজের গণ্ডি ছাড়াইয়া আদালতের বাহিরে কোনও বিষয়ে কোনও প্রয়োজনাতিরিক্ত মন্তব্য না করেন বা কোনও বিষয়ে অহেতুক আগ্রহ প্রকাশ না করেন”।
বিলটি এই মুহূর্তে লোকসভার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছে তাদের মতামতের জন্য। এ জন্য ভূতপূর্ব কিছু বিচারক উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তেনারা সেটাতো করবেনই, কারণ পবিত্রতার মিথটা ভেংগে গেলে তো তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবেন না। যাই হোক, এখানে স্ট্যান্ডিং কমিটি কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন, যেমন; “যাঁহারা ন্যায়-বিচারের দায়িত্বে রহিয়াছেন, তাঁহাদের কার্যপদ্ধতি অনুকরণযোগ্য হওয়া উচিত। তাহা যেন শাসনবিভাগ ও নাগরিকের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা ও দায়িত্বশীলতার ইতিবাচক বার্তা বহন করে। কিন্তু এই উত্তরণ কি আইন করিয়া নিশ্চিত করা সম্ভব? আইন করিয়া বিচারকদের কার্যপদ্ধতি কিংবা ব্যবহারবিধি নিয়মানুগ করা যায় না, এই দায়িত্ব বিচার বিভাগকেই লইতে হবে। প্রত্যেক বিচারককে কাজের পরিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকিয়া আত্মসংযম অভ্যাস করিতে হবে। আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ সংযম”।
কথাটা পুরোপুরি সত্য অন্ততঃ যে দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পেশার লোকেরা অতিমাত্রায় দায়িত্ববহির্ভূত কর্মকান্ডে উৎসাহী থাকে। সেক্ষেত্রে আইন দিয়ে বিচার বিভাগ কিংবা আদালতকে বেধে ফেললে জন দুর্ভোগ আরো বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে আদালতের সাথে বিচারপতিদের সব সময় সব ক্ষেত্রে গুলিয়ে ফেললে কিংবা বিচারপতিদের মাত্রাতিরিক্তিভাবে সমালোচনার উর্ধ্বে রাখলে একইভাবে অন্যায় কিংবা অবৈধ হস্তক্ষেপ বেড়ে যেতে পারে। সব কিছুর জন্য আসলে দরকার একটা বুদ্ধিদীপ্ত এবং দায়িত্বশীল আচরণ।
একই কায়দায় আমাদের দেশে কিছু ব্যক্তি এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠানকে পবিত্র অপবিত্র ধারনার মিথ তৈরি করে সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হয়েছে। এ সকল ব্যক্তিদের সম্পর্কে সমালোচনা করা মানে যে যখন ক্ষমতায় সেই অনুযায়ী ভীষণ অপরাধ। বাকশাল নিয়ে সমালোচনা করলেও শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না, সামরিক শাসন অবৈধ বলতে পার কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াকে নিয়ে বলতে মানা। বিচারপতিদের মতো সেনাবাহিনী, র্যাব এবং শিক্ষক সমাজ নিয়ে কিছু বলা যাবে না। এরা সবাই জবাবদিহিতা এবং সমালোচনার উর্ধ্বে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের, আর বাকীরা অচ্ছুত। কি অদ্ভুত গণতন্ত্র এবং স্বচ্ছতা! মনোরম মত প্রকাশের স্বাধীনতা! পবিত্রতার মিথ তৈরি করে কোন কোনও বিশেষ ব্যক্তি কিংবা কোন নির্দিষ্ট পেশার লোকদের বিশেষ ছাড় পাবার চেষ্টা অত্যন্ত অনৈতিক এবং এটা তাদের দ্বারা পুনঃ পুনঃ অপরাধ সংঘটনের পথ তৈরি করে দেয়। দায়বদ্ধতা এবং জবাদিহিতার উর্ধ্বে কেউ থাকতে পারে না।
এটাও ঠিক মত প্রকাশের অধিকার কখনো লাগামহীন হতে পারে না। তারও একটা সীমানা থাকতে হয়। নিজ অবস্থানকে মনে রেখে সেই অনুযায়ী আচরণ করাই বাঞ্ছনীয়। বিরোধী দলীয় নেত্রীরও তার অবস্থানের কথা মনে রেখে মন্ত্যব্যের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। কোন অকাট্য প্রমাণ ছাড়া তৃতীয় কাতারের নেতাদের মতো যা মনে আসে তাই বলে দেওয়া উচিত নয়। তার মন্তব্যে পরে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বিচারপতির টাকা গ্রহণের একটা যুক্তি দেয়া হয়েছে। এখন তাহলে বিরোধী দলীয় নেত্রীর উচিত তার হাতে থাকা বিচারপতি খায়রুলের ঘুষ খাবার তথ্য প্রমাণ জন সম্মুখে হাজির করা। আসা করি তিনি সেটা করবেন। নয়তো তিনি বাঘ আসা রাখাল বালকের গল্পের মতো জনগণের কাছে আস্থা হারাবেন। অবশ্য খালেদা জিয়ার পক্ষ হয়ে বার সভাপতি একটা যুক্তি দাড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিচারপতিরা সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে টাকা নিয়ে থাকেন; কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে। এটা একটা খোঁড়া যুক্তি। আসলে দেখতে হবে সেটা অবৈধ কিনা। অবৈধ না হলে ঘটনা যতোই বিরল এবং নজীরবিহীন হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তার বক্তব্যের শেষ অংশটা অবশ্য আমলে নেবার মতো। তিনি শেষে বলেছেন যে ঐ বিচারপতি এমন এক সময়ে টাকা নিয়েছেন যখন উনি অনেকগুলি সাংবিধানিক বিষয়ে রায় দিচ্ছিলেন। এ সময় তার অর্থ নেওয়া জনমনে বিভ্রান্তি এবং সংশয় সৃষ্টি করতেই পারে। আমরাও মনে করে সেটা।
কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কোন ধর্মীয় উপসানালয় নয় যে শুধু ভক্তি শ্রদ্ধা করার স্থান। যে সকল বস্তু কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বারে বারে আসার প্রয়োজন হয় তাকে ঘিরে কম্পিউটারের মতো অযথা ভাইরাস ভীতি ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ ব্যাহত করা খুব্ অন্যায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এর মাধ্যমে ঐ সব প্রতিষ্ঠানের যে সব সেবা দেবার কথা সাধারণ মানুষ দূরত্ব তৈরি হওয়াতে সেটা থেকে বঞ্চিত হবে। একইভাবে আদালত মানুষের দৈনন্দির ব্যবেহারের একটা স্থান। এবং আদালত যারা চালান তারাও মানুষ। মানুষের মতোই তাদের লোভ লালসা থাকাটাই স্বাভাবিক। ভুল ভ্রান্তিও হতে পারে তাদের কাজে। কিন্তু ছুত অচ্ছুত ধারনার একটা মিথ তৈরি করে আদালতকে গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তার পরিণতি যে ভাল হবে না সেটা সকলের বোঝা উচিত।
লাল সালুর মজিদের কথা আমাদের অনেকের মনে থাকার কথা। সেই মজিদ যেমন মিথ্যা কবরের উপরে লাল সালু চাপিয়ে একটা পবিত্রতার মিথ তৈরি করে ব্যবসা ফেঁদেছিল, ঠিক তেমনি আমরা কিছু পেশা এবং ব্যক্তিকে ঘিরে একটা পবিত্রতার ধারণা তৈরি করে যে যার মতো ফায়দা লোটার চেষ্টায় আছি। এই তৎপরতা বন্ধ হওয়া উচিত। সবারই থাকতে হবে জবাবদিহিতা।