ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সেই পাখি, এই পাখি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৭ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৭
সেই পাখি, এই পাখি পাখির হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক

আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন জন্মগ্রহণ করে ৫২৮৬ জন। কিন্তু ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে একজন বেশি। জন্মের সময় শিশুর বয়স একদিন হলেও, সেই অতিরিক্ত একজনের বয়স ছিল ৪২ বছর ! ৪২ বছরের সেই নবজাতকের নাম পাখি। জন্মদাতা বাংলাদেশ পুলিশ।

আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে আমার বর্তমান কর্মস্থল বায়েজিদ বোস্তামী থানা। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সহকর্মীদের আন্তরিকতা এবং বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগিতায় এদিনই অপরাধের অন্ধকার জগত থেকে স্বাভাবিক জীবনের আলোতে ফেরে পাখি।

বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক স্যার পাখির হাতে সেলাই মেশিন তুলে দিয়ে আলোর ভূবনে স্বাগত জানান। একদিনের ব্যবধানেই এক সময়কার মাদক সম্রাজ্ঞী পাখি বনে যান টেইলার্স মালিক।

শপথে সুপথে:
২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল সপ্তমবারের মতো গ্রেফতার হয় পাখি। বলা বাহুল্য, তাকে গ্রেফতার করা হয় মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে। কমিউনিটি পুলিশের এক সভায় এলাকাবাসীকে অনুরোধ জানাই মাদকের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে সহযোগিতা করতে। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় গ্রেফতার করা হয় পাখিকে।

তাকে গ্রেফতার করে আমার এক সহকর্মী বলেন, ‘স্যার, এরে নিয়ে আর পারি না। প্রতিবারই ধরি। জেলে পাঠাই। কিন্তু ছাড়া পেয়ে আবার আগের কাজ শুরু করে। ’ তখন বুঝতে পারলাম, এইভাবে তাকে সুপথে আনা যাবে না। বিকল্প কিছুই করতে হবে।

সবাইকে বিদায় করে ডাকলাম পাখিকে। জানতে চাইলাম মাদক বিক্রির কারণ। সে জানাল, তার বিরূদ্ধে বেশ কিছু মামলা চলমান। এসব মামলা চালানোর জন্য তার প্রতি সপ্তাহেই টাকার প্রয়োজন। তাই বাধ্য হয়েই এই পথে থাকতে হচ্ছে তাকে।

জানতে চাইলাম, মামলা চালানোর টাকার যদি বিকল্প কোন সংস্থান দেওয়া হয় তাহলে সে এই অন্ধকার জগত থেকে ফিরে আসবে কিনা।  তখন সে শপথ করে সাপ্তাহিক টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে সে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিবে। এরপর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে তার জন্য বিকল্প আয়ের সংস্থান করি।  দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়ার পর তার সুপথে ফেরার আনুষ্ঠানিকতার দিন ধার্য করা হয়।

পরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১ ডিসেম্বর ২০১৬। কমিউনিটি পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পাখির হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল স্যার। এভাবেই এক শপথে সুপথে ফিরে পাখি। শুরু হয় তার দিন বদলের স্বপ্নযাত্রা। পাখির সঙ্গে লেখক ওসি মোহাম্মদ মহসীন

সেই পাখি, এই পাখি:
পাখি বদলেছে।  বদলেছে তার ভাগ্যও।  তার এই বদলে যাওয়ার বড় একটা অংশজুড়েই আছি আমি। তাই মাঝে মাঝেই দেখতে আসে আমায়। সেদিন পাখি আমাকে দেখতে আসে।  এক হাতে নাস্তার বক্স।  অন্য হাতে একটি পোশাক।  তার নিজের বানানো।  দুটি উপহারই আমার জন্য।  এই দৃশ্য দেখে আবেগ সংবরণ করতে পারিনি।  

পাখির সাথে এটা আমার প্রথম দেখা নয়। এর আগেও তার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে অতিথি হিসেবে নয়, কয়েদি হিসেবে। পরিবর্তিত পেশায় বদলে যাওয়া পাখিকে দেখে যে স্বর্গীয় প্রশান্তি অনুভব করেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

পরে জানতে চাই বদলে যাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা। পাখি জানাল, আয় আগে বেশি হতো। সাথে ছিল এলাকাবাসীর ঘৃণা, বিবেকের দংশন আর পুলিশের চোখ রাঙানি। এখন আয় কম। কিন্তু সাথে পাচ্ছেন এলাকাবাসীর ভালোবাসা, নিরন্তর প্রশান্তি আর পুলিশের সহযোগিতা।

পাখি জানায়, একটি মেশিন দিয়ে নতুন জীবন শুরু করলেও এখন সাথে যুক্ত হয়েছে একটি স্টেশনারি দোকান। পরিকল্পনা আছে তার আরও দুইটি নতুন মেশিন কেনার। পরিকল্পনা আছে তার বদলে যাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের সাথে শেয়ার করার। তার মতো বিপথে যাওয়া মানুষদের ফেরাতে কাজ করতে চায় সে। অভিশপ্ত সেই জীবনের জাবর আর কাটতে চায় না। সে জানায়, এই জীবনেরই অপেক্ষা ছিল তার। সেই পাখি নয়, এই পাখিতেই গর্বিত সে। পাখির স্টেশনারি দোকান

পাখি ছেড়েছে, পাখিকে ছাড়েনি:
শপথ করে সুপথে এসে অন্ধকার জগত ছেড়েছে পাখি। কিন্তু সে অন্ধকার জগত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে পাখিকে! আগের সব মামলা এখনও চলছে। প্রতি সপ্তাহেই তার কমপক্ষে এক হাজার টাকা প্রয়োজন। শুধু সেলাই কাজ করে দৈনন্দিন জীবনে চলার পাশাপাশি মামলা চালানো দুরূহ হয়ে পড়ছে। তাই সে সহযোগিতা চেয়েছে আইনজীবীদের। বাংলাদেশ পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন অন্যদের পালা তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার। পাখির নতুন এই জীবনও তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

এক ঈগল একবার বড় একটি গাছের ওপর ডিম পাড়ে। ঘটনাচক্রে সেই ডিম গাছ থেকে নিচে পড়ে যায়। অক্ষত অবস্থায় ডিমটি সংগ্রহ করে একটি মুরগি। মুরগিটি সেই ডিমকে নিজের মনে করে তাতে তা দেয় এবং পরে বাচ্চা ফোটায়। নিজের অবয়বের সাথে বৈসাদৃশ্য থাকলেও ঈগলছানাটিকে মুরগির মতো করেই বড় করে তোলে। এভাবে অবয়ব ঈগলের মতো হলেও অন্যান্য সব বৈশিষ্ট্য মুরগির মতোই হয় সেই ছানাটির।

একদিন সেই ছানাটি খাবারের খোঁজে বের হয়ে দেখে আকাশে তার মতো দেখতে কতগুলো পাখি উড়ছে। তাদের দেখে নিচে মুরগিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যে যেদিক পারছে পালাচ্ছে। ছানাটিও কোন মতে প্রাণ নিয়ে এক জায়গায় লুকিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি শান্ত হলে ছানাটি তার মাকে বলে, ‘মা, ইস, আমি যদি এই ঈগলের মতো হতাম। সবাই আমাকেও ভয় পেত। ’

আমাদের সমাজে পাখিদের অবস্থাও এইরকম। ভুল জায়গায় ভুল পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণেই তাদের জীবনের চলার পথ বেঁকে যায়। আমরা যদি পাখিদের জন্য সুন্দর পরিবেশ এবং সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে পাখিও ঈগলের মতোই আকাশে উড়বে। মুরগির মতো দিগ্বিদিক দৌঁড়ে পালাবে না।

সেই চেষ্টাই আমি করেছি। আমি মনে করি, আমি সফল। কারণ, পাখিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি জানিয়েছে শহীদনগরের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী নাছিরের পরিবারসহ কুলগাঁও এলাকার মো. সালাউদ্দিন বুলু, চন্দ্রনগর বাজারের শাহনাজ বেগম সানু, রৌফাবাদ রেলবিট এলাকার মো. লিয়াকত ভান্ডারী, সৈয়দপাড়ার নাদিম, স্টারশিপ এলাকার খালেদা বেগমসহ আরও অনেকে।

আমার অন্য ১০ সহকর্মীর মতো ভয়ংকর দুঃসাহসী কোন অভিযানের অংশ হয়তো আমি নই, আমার উদ্ধার তালিকায় নেই একে ৪৭, এম ১৬ কিংবা এম ২২ এর মতো অভিজাত শ্রেণির অস্ত্রও। কিন্তু আমি পাখিকে উড়তে শিখিয়েছি। নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছি। এটাই আমার অর্জন, আমার ১৬ বছরের ক্যারিয়ারের প্রাপ্তি।
জয়তু পুলিশ, জয়তু কমিউনিটি পুলিশিং।

লেখক: অফিসার ইনচার্জ, বায়েজিদ বোস্তামী থানা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।