ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নোবেল শান্তি পুরস্কারের মৃত্যু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
নোবেল শান্তি পুরস্কারের মৃত্যু নাফ নদীর ওপারে জ্বলছে রাখাইন রাজ্য। ছবি: বাংলানিউজ

নাফ নদীর দুই তীরে হাজার হাজার মৃত দেহের পাশে লুটিয়ে পড়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মরে পচে ভেসে ওঠা অসংখ্য মরদেহের মিছিলে অং সান সুচির নোবেল শান্তি পুরস্কার এখন আর কোনও মূল্য বহন করে না। জাতিগত নিধনযজ্ঞ থামানোর  অক্ষমতার পাশাপাশি জাতিসংঘে বিশ্বনেতৃত্বের সামনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি হত্যাকারীদের সঙ্গে নিজের অবস্থানকে নিশ্চিত করেছেন।

তিনি, অং সান সুচি, শান্তির পদক ধারণ করে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম খুনিদের দোসরে পরিণত হয়েছেন। আগামী ইতিহাস  হিটলার, মুসোলিনি, মিলেনোভিচ, ইয়াহিয়া খানের পাশে স্থান দেবে তাকে।

তিনি থাকবেন অন্য খুনিদের চেয়ে আলাদা। তিনি শান্তির জন্য পুরস্কার পেয়ে নিরীহ মানুষের  মৃত্যুর সানাই আর নোবেল শান্তি পুরস্কারের মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়েছেন।

ডিনামাইট আবিস্কারক আলফ্রেড নোবেল পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন। তার আবিস্কৃত ডিনামাইট অগণিত মানুষকে যুদ্ধের প্রান্তরে নিহত করেছে। হয়ত এই পাপবোধ থেকেই তিনি নোবেল পুরস্কার চালু করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রের সঙ্গে শান্তিতেও নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।

কিন্তু নোবেল পুরস্কার কখনোই প্রশ্নের বাইরে ছিল না। ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এমন অনেকেই পুরস্কারটি পেয়েছেন, যারা সমালোচিত মানুষ ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চার্চিল কম গণহত্যা করেন নি। যুদ্ধে পরাজিত হলে হিটলারের বদলে তাকেই মানুষ ঘৃণা করতো। সেই চার্চিল নোবেল পুরস্কারের অধিকারী। রাজনীতির এমন বহুজন দুই হাতে  মানুষের রক্তের দাগ নিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেছেন।

প্রতিদিনই পারিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।  ছবি: বাংলানিউজসাহিত্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রশ্নবিদ্ধ মানুষ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যারা পশ্চিমা দালালি বা বিশেষ কোনও ‘পারপাস’ বা ‘দায়িত্ব’ পালনের পুরস্কার স্বরূপ সম্মানিত হন। ফলে নোবেল বা অন্য সব পুরস্কারই বিশেষ কারণে বিশেষ পছন্দের মানুষদেরকেই দেওয়া হয়। অতএব, পুরস্কার কখনোই সত্যের মানকাঠি নয়।

তথাপি পুরস্কার পাওয়ার পর আশা করা হয় যে, পুরস্কৃত ব্যক্তি অন্তত চোখলজ্জার ভয়ে এমন কাজ করবেন না, যা তার প্রাপ্ত পুরস্কারের বিপক্ষে যায়। কিন্তু সুচি কি করলেন? বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যার প্রতিবাদ তো দূরঅস্ত, একটি কথাও বললেন না। সাফাই গেয়ে কথা বললেন হত্যাকারী জান্তার পক্ষে। বছরের পর বছর হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে মেরে-কেটে, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে রাখেন তিনি। এমন কি, সাম্প্রতিক সময়ে যে পাশবিক নরহত্যার সূচনা হয়েছে, তার দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর, সেটাকে আমলই দিলেন না। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে বিশ্ব যখন স্তম্ভিত এবং মানবতা যখন ক্রন্দনরত, তখন সুচি নানা দেশের নেতাদের তার দেশে স্বাগত জানাচ্ছেন। নিজেদের হত্যাকারীর ভূমিকাকে জায়েজ করছেন। লজ্জাহীনভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা নিধনের কাজটিই করছেন তিনি। এবং সেটা করছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার গলায় ঝুলিয়ে। নূন্যতম মানবিকতা থাকলে তিনি রক্তাক্ত মিয়ানমারে শান্তির পদক ছুঁড়ে ফেলে দিতেন।

সুচির কলঙ্কিত আচরণ নোবেল শান্তি পুরস্কারকে চরম হাস্যকর করে তুলেছে। ‌এখনকার রক্তাক্ত অবস্থান তারই অতীতের সংগ্রামী আন্দোলনকে ম্লান করেছে। বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আরাকান থেকে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলোর চোখে সুচির গলায় ঝুলানো পুরস্কার হত্যাকারী দৈত্যের মতো লাগছে। মৃত শিশুরা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তাদের মৃত্যুপুরী স্বদেশের এই নেত্রীর দিকে। বিশ্বময় ঘৃণার শব্দে তার নোবেল প্রত্যাহারের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে। একদা যারা সুচির পক্ষে মিছিল করেছে তারাই এখন নিন্দায় মুখর তার বিরুদ্ধে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী।  ছবি: বাংলানিউজহাজার হাজার মৃত্যু আর দেশত্যাগী উস্তাস্তু নারী-শিশুর সামনে সুচি এবং নোবেল পুরস্কার এখন হন্তারকের নামান্তর। পাশবিক আক্রমণে আরাকানের বিরাণ জনপদের অজস্র লাশের সারিতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের মৃত্যু হয়েছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি-লেখক-গবেষক। প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।