ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রোহিঙ্গা: যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কাছে প্রত্যাশা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
রোহিঙ্গা: যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কাছে প্রত্যাশা নির্যাতনের মুখে আরাকান ছাড়ছে অসহায় রোহিঙ্গারা।

হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে এখনো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। ২৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করার নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। এটি আসলে তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনারই ফল।
 

জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রথমে কোনো পদক্ষেপ না নিলেও এখন অনেকেই মুখ খুলেছে। নিন্দা-প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে টু শব্দটি না করলেও এখন তারাও অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদিও নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি তারা রাষ্ট্রীয়ভাবেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। আর রাশিয়া ও চীন তো মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
 
তবে, বাংলাদেশের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় অনেক দেশই এখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে এখন অনেকেই সোচ্চার। কিন্তু কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপ না দিলে, শুধু নিন্দা-প্রতিবাদে এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব। শুধু বাক্যবানে জাতিগত নিধন বা শরণার্থী সংকট সমাধানের কোনো আন্তর্জাতিক নজির আমাদের কাছে নেই। যেখানে একটি রাষ্ট্র কোনো জাতি-গোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ চালায়; সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হয়।
 
মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘের সামরিক সম্পর্কচ্ছেদ এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সামরিক অসহযোগিতা বা নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সামরিক অসহযোগিতা মানে সামরিক শক্তি প্রয়োগ নয়; বরং মানবাধিকার লংঘনকারী রাষ্ট্রকে নিবৃত করাই এর উদ্দেশ্য। শুধু অব্যাহত সামরিক অসহযোগিতাও এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। সামরিক শক্তিপ্রয়োগই শেষ কথা নয়, সামরিক নিষেধাজ্ঞাও (arms embargo) ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। সামরিক সম্পর্কচ্ছেদ করার এমন নজির আরো আছে। সব সামরিক অস্ত্র-সরঞ্জামাদিকেই এর আওতাভুক্ত করতে হবে। সব ধরনের সহায়তা স্থগিত করতে পারলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ প্রশস্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে সামরিক সহায়তা বন্ধ করলে তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি দমন-পীড়ন নীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। মিয়ানমারে সামরিক অস্ত্রের বড় যোগানদাতা চীন ও রাশিয়াকেও এগিয়ে আসতে হবে। আর এ দুই পরাশক্তিকে নিবৃত করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘকেই এগিয়ে আসতে হবে।
 
সামরিক নিষেধাজ্ঞা বা অসহযোগিতা (comprehensive arms embargo) যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকেও আসতে পারে। মানবাধিকার লংঘনকারী মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের কোনো আর্থিক-পেশাগত সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে জাতিসংঘ-যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মানবাধিকার লংঘন করছে সেখানকার পশ্চিমাঞ্চলের সেনাকমান্ড, ৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন ও বর্ডার গার্ড পুলিশের সদস্যরা। এছাড়া সেনাবাহিনীর প্রধান, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লায়িং ছাড়াও এসব বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক-জাতিসংঘ প্রদত্ত সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করলে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। যুক্তরাষ্ট্র এ কাজে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। তারা মিয়ানমারের সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বন্ধ করে দিয়েছে সেনা কর্মকর্তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ। অন্যান্য দেশ ও জাতিসংঘও অনুরূপ উদ্যোগ নিতে পারে।
 
আগস্টের শেষ দিকে রাখাইনে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেখানে মানবিক সাহায্য দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো মানবাধিকার সংগঠন, পর্যবেক্ষক এমনকি সাংবাদিকদেরও ঢুকতে দিচ্ছে না। খুবই সীমিত পরিসের কাউকে হয়তো প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবক্ষেণের দাবি জানাতে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও যাতে সেখানে যেতে পারে সেজন্য চাপ দিতে হবে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। তারা রাখাইনের মানবাধিকার পরিস্থিতির নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বকে জানালে জনমত তৈরি হবে।
 
শুধু সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদেরই নয়, বরং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকেও প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। কোনো ত্রাণ-মানবিক সহায়তামূলক কার্যক্রমও চালাতে দিচ্ছে না। সেখানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার জরুরি। এটি একটি আন্তর্জাতিক রীতি। যুক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘ এ বিষয়ে চাপ দিতে পারে।
 
২৫ আগস্টের পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ৩২ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের একার পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নেয়া অসম্ভব। অবশ্যই বহির্বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে এটাই প্রত্যাশা।
 
মিয়ানমার যাতে দ্রুত রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ করে এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয় সেজন্য তাদের ওপর চাপ দিতে হবে। এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, তাদেরকেই সমাধান করতে হবে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে একটি জাতি-গোষ্ঠীর ওপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে; তা আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী। প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।