ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যে ভুল পথে যেতে চাইছেন খালেদা

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিংএডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১১
যে ভুল পথে যেতে চাইছেন খালেদা

রোডমার্চের প্রথম দিনেই মোটামুটি সফল খালেদা জিয়া। অর্থাৎ সিলেট রোড মার্চের পথে পথে তার কর্মসূচি ঘিরে জনসমাগম ভালো হয়েছে।

পথসভাগুলো রূপান্তরিত হয়েছে জনসভায়। খালেদা জিয়ার আগের একটি আলোচিত রোডমার্চ ছিল পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে। সেই রোডমার্চ কাচপুরের কাছে শামীম ওসমান বাহিনীর কাছে বাধাগ্রস্ত হলে থেমে থাকে সারাদিন। এবার সিলেটগামী রোডমার্চ ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে পেরেশান-ব্যস্ত শামীম ওসমান বা সরকারি তরফের কেউ তাতে আত্মঘাতী বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেনি। উল্টো পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিরোধীদলের নেত্রী আর রোডমার্চের নিরাপত্তার প্রশংসনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। গুড জব! শুকরিয়া। এটিই গণতন্ত্র।

কিন্তু এমন একটি রোডমার্চ কভার করা কতটা যে বিরক্তিকর ও কষ্টসাধ্য, তা বহরসঙ্গী সাংবাদিকরা জানেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবের খবর ছাপা হয়েছে। বিএনপি দলটিই এরকম অগোছালো। অথবা এটিই তাদের সংস্কৃতি! এমন বহরের আরেক সমস্যা হলো, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই বক্তার ঘ্যানর ঘ্যানর! সে কারণে পথে পথে রিপোর্টারদের সারাদিন একই বক্তৃতা শুনতে শুনতে বিস্বাদ লাগে। এক বক্তৃতা থেকে আরেক বক্তৃতার জায়গার নাম বাদে আলাদা পয়েন্ট বের করা কঠিন। ট্রেনমার্চে এ সমস্যা আরও বেশি। কারণ ট্রেন মার্চের ট্রেন তখন প্রায় সব স্টেশন থামে অথবা থামাতে হয়। সোমবারের ভ্যাপসা গরমে কাবু সিলেটগামী রোডমার্চে বক্তৃতার স্পট কম থাকাতে প্রায় একই বক্তৃতার ঘ্যানর ঘ্যানর বহরসঙ্গী সাংবাদিকদের কম শুনতে হয়েছে।

তারাবোর প্রথম জনসভাতেই অবশ্য রোডমার্চ কর্মসূচির মূল বার্তাটি সরকারকে দিয়ে দেন খালেদা জিয়া। অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন তারা মানবেন না। হতে দেবেন না। নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেও আসতে হবে। অথবা তারাও আসবে। কনফিডেন্ট ভয়েস! এটি যেন শেখ হাসিনার সেই বক্তব্যেরই জবাব! নিউইয়র্ক থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই পরবর্তী নির্বাচন ‘হবে হবে হবে’। বিএনপি নির্বাচন চাইলে তাদেরও সে নির্বাচনে আসতে হবে। আর খালেদা জিয়া বলে দিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে হবে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাকে!
 
ওয়াকিফহালরা জানেন ৬৭ বছর বয়সী খালেদা জিয়া এখন অসুস্থ। বাইরে সেজেগুজে ফিটফাট থাকলেও শরীর তার ভালো যাচ্ছে না। আজকাল তাই প্রায় ‘জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে’ এমন কথাও বলেন। সোমবারের রোডমার্চের দ্বিতীয় সমাবেশেই বলে দিয়েছেন, তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। আর প্রধানমন্ত্রী হবার শখ নেই। আগামীতে নেতৃত্ব যুবসমাজের হাতে তুলে দিতে চাই’।

বলাবাহুল্য, খালেদা জিয়ার এই যুবসমাজ মানে কিন্তু জাতীয়তাবাদী যুবদলের কোনো নেতা না। তার যুবক মানে তারেক রহমান। দুর্নীতির মামলার কারণে এখন দেশে আসতে পারছেন না। কাজেই মা তার ছেলেকে দেশের মালিক বানাতে নিরাপদ একটা পরিবেশ-পরিস্থিতি চান। নিরাপদ পরিবেশ-পরিস্থিতি মানে শেখ হাসিনার সরকারকে ফেলে দিতে হবে। সে কারণেই খালেদা জিয়ার রোডমার্চ!
 
এরপর খালেদা জিয়া এভাবে না-ওভাবে কথার ফাঁকতালে বলে দিয়েছেন, তার দ্বিতীয় টার্গেট। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে জামায়াতে ইসলামীকে রক্ষার নিয়ত। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার একটি দলকে শেষ করে দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীকে মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। তারা মাঠে নামলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। কিন্তু তা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। ’ এই হলো গিয়ে তার রোডমার্চ তথা সরকারকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিয়ে তার নির্ধারিত আগামীর প্রধান দুটি টার্গেটের মঞ্জিল-এ মকসুদ-- তারেক বাঁচাও! জামায়াত বাঁচাও!

এসবের ফাঁকে কোটি টাকার রোডমার্চের অন্যসব বক্তৃতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনার নাম না উল্লেখ করে বলেছেন, সরকারের এক নম্বর থেকে সব দুর্নীতিগ্রস্ত! বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতিমুক্ত পদ্মাসেতু করবেন, ইত্যাদি। তার আমলেও দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়েছে দেশ। হাওয়া ভবন নাম দিয়ে পৃথক হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে আজান দিয়ে দেশে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন(!) রাজনৈতিক সচিবদের একজন ব্যাংক-মিডিয়াসহ নানান সম্পত্তিতে ধনকুবের হয়েছেন! আরেকজন সেই যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, এখনও নিখোঁজ! ছেলেদের পাচার করা টাকা আমেরিকা-সিঙ্গাপুরের মতো পৃথক দুটি বিদেশি রাষ্ট্রের মাধ্যমে আটক-জব্দ হয়েছে বিদেশি ব্যাংকে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো স্বীকারোক্তি বা অনুশোচনা নেই!
 
এরপর বিরোধীদলের নেতার মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে খালেদা জিয়া যা করেছেন, তা স্রেফ নোংরামি। গত পূজায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ রাজধানীর আরও একাধিক মণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, খালেদা জিয়া তাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইবোনকে পূজার শুভেচ্ছা জানাতে পাঠিয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দেখতে যাওয়ায় খালেদা জিয়া কিনা তাকে কটাক্ষ করে বললেন, এ সরকার এখন দেবদেবীর পূজা করা শুরু করেছে। তারা আল্লাহ-খোদা মানে না। সংবিধান থেকে আল্লাহ-খোদার নাম তুলে দিয়েছে, ইত্যাদি!
 
এমন নোংরা বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দু সম্প্রদায় তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে কী বার্তাটি দিতে চাইলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন এবং বিরোধীদলের নেত্রী? ২০০১ সালে তারা নির্বাচনে জেতার পর সারাদেশ জুড়ে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির-উপাসনালয়ে হামলা-ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত তাণ্ডব ঘটেছিল, আবার কী বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির উস্কানি দিয়ে রাখলেন বিরোধীদলের নেত্রী? দুর্ভাগ্য আর কী!

মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কী করে সম্ভব? খালেদা জিয়া ক্ষমতায় গিয়ে নিজামী-মুজাহিদের মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীকে উপদেষ্টা করেছেন। এখনও তাদের সঙ্গে নিয়ে ছায়াতলে নিরাপত্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর দেশের দীর্ঘ বিচারবঞ্চিত শহীদ পরিবারের সদস্যদের টিটকারি মেরে বলছেন, আমরাও বিচার চাই!
 
মুক্তিযুদ্ধের শহীদ আর শহীদ পরিবারগুলোর সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর উপহাস আর কত? বা সত্যিকারের বিচার চাইলে এ বিচার এখন বন্ধ করতে চাইছেন কেন? তা কি খালেদা জিয়া প্রকারন্তরে দেশের মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলতে চাইছেন, এ বিচার আমি করতে দেব না, পারলে আমাকে ঠেকাও!
 
ক্ষমতার বাইরে গেলে ভারতবিরোধী কার্ড আর ক্ষমতায় গেলে ভারত তোষণ,  বিএনপি আর খালেদার জিয়ার নতুন স্বভাব না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিএনপি সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল। তাহলে বাংলাদেশটা এভাবে একচ্ছত্র ভারতীয় পণ্যের বাজার হয়ে গেল কি করে? সারাদেশের পথজুড়ে এসব সবুজ সিএনজি অটো, কালো ট্যাক্সি এসব এদেশে কে আমদানি করেছে? বাংলাদেশকে এসব ভারতীয় লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির একচেটিয়া বাজার করে দিতে কেন বিএনপি এদেশে জাপানি গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল? ভারতীয় ব্যবসায়ীরা কোকোকে টাকা বেশি দিয়েছিল তাই?
 
আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া উচ্চকণ্ঠ। দুর্নীতি যে দেশে এখনো হচ্ছে, তা পদ্মা সেতুর টাকা বিশ্বব্যাংক আটকে দেবার ঘটনায় চিহ্নিত। কিন্তু খালেদা জিয়াতো আগে নিজের জমানার আর ছেলেদের দুর্নীতি স্বীকার করবেন! কই জিয়ার অর্থনৈতিক দুর্নীতির কথাতো দেশের কোন মানুষ, এমনকি আওয়ামী লীগও বলে না! বিদেশের কোন ব্যাংকেওতো জিয়ার একটা পেনি জমা থাকার ঘটনা কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি! সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে তারেক-কোকোর জমা টাকার ঘটনা কি অস্বীকার করার ‘জো’ আছে? কোকোর টাকাতো জব্দ হয়েছে আমেরিকার ফেডারেল কোর্টের মাধ্যমে!
 
এসব হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা খালেদা জিয়া যদি স্বীকার না করেন, তাহলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার কথাবার্তা কি চোরের মায়ের বড় গলার মতো শোনাচ্ছে না? এসব বিষয়ে সাফসুতরো না হলে দেশের মানুষ কেন তাকে বিকল্প ভাবতে চাইবে? আর দেশের চল্লিশ বছর পর হতে যাওয়া অমীমাংসিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পণ্ড করা যদি তার আরেকটি আসল নিয়ত হয়, তাহলেতো রোডমার্চ অ্যাক্সিডেন্টে পড়বে। তখন দেখা যাবে দুর্ঘটনায় আহত খালেদা জিয়াকে উল্টো লাইফ সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।   মঞ্জিল-এ-মকসুদও বহুদূর!

এর আগে একবার খালেদার আমলে শেখ হাসিনার ট্রেনমার্চে ঈশ্বরদী স্টেশনে ট্রেন লক্ষ্য করে গুলি হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে কাচপুরের কাছে সারাদিন আটকে রাখা হয়েছে খালেদা জিয়ার রোডমার্চ! কিন্তু এবার সিলেট পর্যন্ত রোডমার্চে কোনও বাধা দেওয়া হয়নি। উল্টো প্রশাসন ও পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। এর জন্যে সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু রোডমার্চের বার্তাটি যেন জানার-বোঝার চেষ্টা করে সরকার। অর্থাৎ সবাইকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সামনের নির্বাচন অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা নিয়ে যাতে গোঁয়ার্তুমি করা না হয়।
 
খালেদা জিয়ার সিলেট মার্চে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে একটি শব্দও ছিল না। এটি সরকারের সাফল্য। সংবিধান সংশোধনের সময় বিএনপিকে বারবার বলা সত্ত্বেও দেশের মানুষ দেখেছে তারা যায়নি। আর এখন খালেদা জিয়া মিথ্যা বলছেন যে সংবিধান সংশোধনের সময় বিএনপির কোন বক্তব্য নেওয়া হয়নি! নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সরকারের ডাকে আলোচনায় বিএনপি চলে যাবে এটিও বিশ্বাস করার মতো লোকের অভাব দেশে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যাতে সরকারের আন্তরিকতার অভাব না থাকে। দেশের মানুষ যাতে কনভিন্সড হয় যে, সরকার এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার আন্তরিক চেষ্টা করেছে। এ চেষ্টার বিষয়টি যাতে লোক দেখানো না হয়।

কিন্তু কোনোভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে গোঁয়ার্তুমি করা চলবে না। রাজনৈতিক এ ইস্যুটি বিএনপির হাতে চলে গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গ্রেনেড হামলা, তারেক-কোকোসহ দুর্নীতির মামলার আর দশ ট্রাক অস্ত্রচোরাচালানের বিচারের মতো সরকারের ফরজ কাজগুলোর  বাধাগ্রস্ত হবে। এর একটিও যদি অসম্পূর্ণ থাকে, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে এর চড়া মাশুল দিতে হবে। শেখ হাসিনার সরকার যেন এটি ভুলে না যায়!
 
ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।