ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবউল্লাহ: অম্লান বীরত্বগাথা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবউল্লাহ: অম্লান বীরত্বগাথা ডা. মো. হাবিবউল্লাহ ও তার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি

১৯৭১ সালের শেষ দিক। চারদিকে তখন বিজয়োল্লাস। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরছেন কেউ জীবিত, কেউবা মৃত। শুধু ফিরছেন না ফকু। এমনকি টানা নয় মাস যুদ্ধ চলাকালেও কোনো হদিস মেলেনি তার। সন্তানের ফেরার আশার অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে গেছে হালিমা খাতুনের। এভাবে পেরিয়ে গেছে এক মাস। একদিন হঠাৎ অলৌকিক কিছু দেখে চমকে যাবার মতো ঘটলো এক ঘটনা। ছিপছিপে শরীরের এক লোক হাজির ঘরের আঙিনায়। তিনি আর কেউ নন- ফকু, শুধু চিনতে খানিকটা সময় লেগেছে বাড়ির লোকদের, এই যা। 

বিয়ের পর এসব কথা শুনেছি আমার সহধর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবউল্লাহ (যার ডাক নাম ফকু) আর আমার শাশুড়ী বীর মাতা হালিমা খাতুনের কাছ থেকে। এরপর বিভিন্ন সময় সুযোগ পেলেই আমার কাছে যুদ্ধকালীন নানা স্মৃতিচারণ করেছেন হাবিবউল্লাহ।

আমি এখন তার সেই স্মৃতির পাতা থেকেই কিছু ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।  

তার নাম ডা. মো. হাবিবউল্লাহ। ডাক নাম ফকু। জন্ম পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানায়। বাবার নাম হাসমত আলী এবং মায়ের নাম হালিমা খাতুন। ছয় ভাই আর তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কলাপাড়ায়ই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী আর মেধাবী। বরিশালের বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক)। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। পরোপকারী, অসীম সাহসিকতা আর নেতৃত্বপূর্ণ গুণাবলীর জন্য ১৯৬৯ সালে তিনি নির্বাচিত হন মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে।  
ডা. মো. হাবিবউল্লাহ  চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) শিক্ষার্থী ছিলেনএকাত্তরে হাজারো মুক্তি পাগল দামাল ছেলের মতো বিজয়ের নেশা প্রতিনিয়ত তাড়া করতো হাবিবউল্লাহকে। প্রতি মুহূর্তে ভাবতেন, জীবনের বিনিময় হলেও দেশ ছাড়া করতে হবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের। শত্রুমুক্ত করতে হবে এই দেশকে। শুরু হলো স্বাধীনতার স্বপক্ষে গণজাগরণ। দেরি না করে তৎকালীন আগরতলা ষড়যন্ত্রের সময় প্রধানমন্ত্রীর ভূতপূর্ব রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদের (বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী) নির্দেশনায় চট্টগ্রামবাসীকে গণজাগরণে একাত্ম করার অগ্রণী দায়িত্ব নেন মো. হাবিবউল্লাহ। ২৫ মার্চ কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন এক নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন তিনি। পার্বত্য এলাকার দুর্গম পথ পেরিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে (সংক্ষেপে এসএফএফ যা ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থা) যোগ দিয়ে রণকৌশল ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেন দেমাগ্রি মিলিটারি ক্যাম্পে।  

পরের ইতিহাস শুধুই সংগ্রামের। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একের পর এক চালান বিধ্বংসী সব অপারেশন। এক পর্যায়ে যোগ দেন মুজিব বাহিনীতে। যুদ্ধকালীন কমান্ডার প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের বিপক্ষে একের পর এক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবউল্লাহ। আর এসময় কতোবার যে তিনি আল্লাহর অসীম কৃপায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। এমনি একটি ঘটনা ঘটলো একাত্তরের নভেম্বরে।

হাড় কাঁপানো শীতের রাত। শত্রুপক্ষের নজর এড়াতে প্রতিদিনের মতো সেদিনও আস্তানা বদল করে পাহাড়ের কোনো এক নির্জন স্থানে ঘাঁটি গাড়লেন হাবিবউল্লাহ ও তার সহযোদ্ধারা। সুযোগ পেলেই হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায় এমন একটি স্থান বেছে নিলেন। সে সময় তৎকালীন চাকমা রাজার আমন্ত্রণে সেখানে রাতের খাবার খেতে যান তারা। পরিবেশন করা হয় রান্না করা পাহাড়ি মুরগির মাংস আর ভাত। সেসময় পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। দলের মধ্যে হাবিবউল্লাহর একজন সহযোদ্ধা ছিলেন সুজ্জত হাওলাদার, যিনি প্রাণের চেয়েও যেন বেশি ভালবাসতেন তাকে। তাই রান্না করা মাংস থেকে কলিজার টুকরো হাবিব উল্লাহর জন্য বেছে আলাদা করে লুকিয়ে রাখলেন সুজ্জত হাওলাদার। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই আস্তানায় ফিরে গেলেন। কিন্তু সুজ্জত ফেরার পথে হাবিবউল্লাহকে লুকানো কলিজাগুলো খওয়ানোর জন্য একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন। এর মিনিট দুয়েকের মধ্যে বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো পুরো এলাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আস্তানা লক্ষ্য করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় পাকিস্তানিরা। এ সময় কতো যোদ্ধা যে প্রাণ হারালো আর কতো জন যে আহত হলো—বলতে বলতে আল্লাহর রহমত আর সুজ্জত হাওলাদারের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে এলো হাবিব উল্লাহর। বললেন, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি।  

সদালাপী আর বন্ধু সুলভ আচরণের অধিকারী ছিলেন হাবিবউল্লাহ। হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করতে অস্ত্র চালনা ও অন্যান্য কৌশল রপ্তের পাশাপাশি চিকিৎসক হওয়ায় দলের বহু যুদ্ধাহতকে সেবা করে সুস্থ করেছেন। তাই সুজ্জত হাওলাদারের মতো তার প্রতি একটু আলাদা ভালবাসা ছিল দলের অন্যান্য যোদ্ধাদেরও। আর এর প্রমাণও হাবিবউল্লাহ পেতেন এক একটি অপারেশকালে, যখন পাকিস্তানিরা মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করতো, সহযোদ্ধারা চারদিক ঘিরে রাখতেন হাবিবউল্লাহকে, যেন তার গায়ে কোনো গুলি না লাগে। আর এজন্য তাকে ঘিরে রাখা অনেক যোদ্ধাকে তিনি কাছ থেকে গুলিতে প্রাণ দিতেও দেখেছেন।  

অপারেশনকালে কতো বিভীষিকাময় রাত যে পার করেছেন হাবিবউল্লাহ, তা বলে শেষ করা যাবে না। এমনও সময় গেছে, যখন দিনের পর দিন শুধু পাহাড়ি জলাশয়ের মধ্যেই কাটিয়েছেন। বড় বড় জোঁক রক্ত খেয়ে আপনাআপনিই শরীর থেকে ঝরে যেতো, তবু নড়াচড়ার উপায় ছিল না। কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে শুধু নাকটাই বের করতে পারতেন। কারণ আশ-পাশে পাকিস্তানি সেনাদের টহল। তবে সুযোগ পেলেই সেই সেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতেন। এভাবে একের পর এক পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধাভিযানের মধ্য দিয়ে কেটে যায় দীর্ঘ নয় মাস। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে অবসান হয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির।  

১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মো. হাবিবউল্লাহ। এরপর বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মেডিকেল অফিসার হিসেবে খেপুপাড়া, বাউফল স্বাস্থ্য কমপ্লক্স ও বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তখনও রেশ কাটেনি জাতির জনক, স্বাধীন সার্বভোম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের উদ্দীপনা। হাবিবউল্লাহ স্বপ্ন দেখতেন, সোনার বাংলা গড়ায় আত্মনিয়োগকারী তিনিও হতে পারেন একজন।  

মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় বহুবার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান হাবিবউল্লাহ। সেজন্য দেশসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা কোনো কঠিন কাজ নয়, ভাবতেন হাবিবউল্লাহ। কিন্তু তাসের ঘরের মত ভেঙে যায় সেই স্বপ্ন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার করার পর দুর্বল হয়ে পড়ে হাবিবউল্লাহর মনোবল।  

এর দুই বছর পর দেশ ছেড়ে পাড়ি দেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে। উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়াতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ছিলেন প্রায় দশ বছর। এরপর আবারও ফিরে আসেন নিজ দেশে। রাখেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের স্বাক্ষর। রাজধানীর চাকচিক্য আর বিলাসবহুল জীবনের সুযোগ ত্যাগ করে জন্মভিটের টানে তিনি ফিরে যান নিজ জেলা পটুয়াখালীতে। সেখানকার মানুষের চিকৎসা সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য তিনি সেখানে একটি ক্লিনিক গড়ে তোলার কাজেও মনোনিবেশ করেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসের কাছে সবাইকে হার মানতে হয়। ডায়াবেটিক ও কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন হাবিবউল্লাহ। অবশেষে ১৯৯১ সালের ২ মে  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. হাবিবউল্লাহ।

তিনি রেখে যান স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে। দেশের জন্য মহান অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০০ সালে তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ পত্র (নং- ২০৭৫৯) প্রদান করা হয়। মুক্তিবার্তায় তার যোদ্ধা নং ০৬০৩০১০১০৫ এবং গেজেট নং পটুয়াখালী-১৪৫।
  
আমরা এখন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত একটি জাতি। প্রতিদিন স্বাধীনতার জ্বলজ্বলে সূর্যটা আমরা দেখতে পাই আমাদের মাথার ওপর। মুক্ত হাওয়ায় বুক ভরে নিই নিঃশ্বাস, আমরা যখন যেভাবে খুশি এগিয়ে যাই, যখন যা ইচ্ছে হয় করি। এক কথায় দেশ ও দশের উন্নয়নের চাবিকাঠি এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।  

এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন বাংলার যে বীর সেনানীরা, বিজয়ের এই মাসে আমি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই তাদের। যতদিন বিশ্ব মানচিত্রের বুকে টিকে থাকবে এই বাংলাদেশ, ততদিন তাদের এই অসীম বীরত্বগাথা চির অম্লান হয়ে থাকবে।  



লেখকএস এম জাকিয়া লাইজু
এস এম জাকিয়া লাইজু

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।