ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনকে মনে আছে?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৭
চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনকে মনে আছে? চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন (ফাইল ফটো)

আশির দশকে কয়েকটি হাতেগোনা ছাপানো দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের মাঝে মোনাজাত উদ্দিনের নাম উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বিশেষত সে সময়কার মফস্বল সাংবাদিকতা জগতের ‘রোল মডেল’ ছিলেন তিনি। অভিধা পেয়েছিলেন ‘চারণ সাংবাদিক’-এর।

সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুর শহরে এবং ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় গাইবান্ধার কালাসোনার চরের কাছে ফেরি থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরদিন (৩০ ডিসেম্বর) তাকে সমাহিত করা হয়।

আশির দশকে ঢাকায় তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে ইত্তেফাক ভবনে, শাহবাগে, সংবাদ অফিসে। তিনি তার একাধিক গ্রন্থ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, যেগুলো আমি সাপ্তাহিক রোববার-এ রিভিউ করি। নিজেকে তিনি দাবি করতেন ‘তৃণমূল মানুষের সংবাদকর্মী’ হিসাবে।

কাজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ছিলেন তিনি। অফিসের ডেস্কে বসে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহের পরিবর্তে গ্রামে-গঞ্জে, পথে পথে ঘুরে ঘুরে খবরের পেছনে থাকা খবর আর জানা-অজানা নানা কথা ও কাহিনী তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে যোগ করেছিলেন তিনি নতুন মাত্রা। চষে বেড়িয়েছেন উত্তরবঙ্গের মাঠের পর মাঠ, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। গেছেন শেকড়ের সন্ধানে। কথা বলেছেন মাটিস্পর্শী মানুষের সঙ্গে। একেবারে শেকড় থেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন সংবাদ ভাষ্য, প্রতিবেদন, ফিচার।

যা কেউ দেখেননি, তিনি তা তুলে ধরতেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনজীবনের সমস্যা, সম্ভাবনা ও মানবিক অনুভবের নানাদিক তিনি তার অণুবীক্ষণ পর্যালোচনার মাধ্যমে শক্তিশালী লেখনিতে ধারণ করেছেন। তার প্রতিটি প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম চিত্র আর মানুষ ও সমাজের বাস্তব মুখচ্ছবি।

সাংবাদিকতা ছিল তার কাছে সার্বক্ষণিক ধ্যান ও জ্ঞান। ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি নিজের সুখ-দুখের কথা ভুলে গিয়ে মানুষের কথা লিখেছেন। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলেছেন সংবাদ সংগ্রহের কাজে। গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অনটন সবকিছুই তুলে নিয়ে এসেছেন। নিষ্ঠার সঙ্গে ছেপেছেন সংবাদপত্রে। কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য, শোষণ ও মঙ্গা তার কলমে কথা বলেছে। তিনি তুলে ধরেছিলেন ভূমি সংলগ্ন সংগ্রামী মানুষের আদি-অন্তহীন পদধ্বনিও।

বহু গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তার মাঝে। মোনাজাত উদ্দিন কেবল একজন সাংবাদিকই ছিলেন না, সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার দখল ছিল। তিনি রচনা করেন একাধিক ছোট গল্প, নাটক, ছড়া ও প্রবন্ধ।

উত্তর জনপদ তথা দেশের অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান, সাহসী শ্রমনিষ্ঠ ও নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতে যাওয়ার পথে প্রমত্তা যমুনা নদীতে বাহাদুরাবাদগামী বাংলাদেশ রেলওয়ের শেরেবাংলা ফেরিতে কালসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে ছবি তুলছিলেন। আকস্মিকভাবে ফেরি থেকে পড়ে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান। পরদিন ৩০ ডিসেম্বর হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি।

সাংবাদিকতার সার্বক্ষণিক ব্যস্ততার পরেও তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভিত্তিতে রচিত তার গ্রন্থগুলোও তাকে স্মরণীয় করে রাখবে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: পথ থেকে পথে (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯১, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা), সংবাদ নেপথ্য (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯২, প্রকাশক: বিপ্লব প্রসাদ, রংপুর), কানসোনার মুখ (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯২), পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৩, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা), নিজস্ব রিপোর্ট (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা), ছোট ছোট গল্প (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা), অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: গ্রামীণ পর্যায় থেকে (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৫),  চিলমারীর একযুগ (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৫, প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী), শাহা আলম ও মজিবরের কাহিনী (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫, প্রকাশক: দিব্য প্রকাশ), লক্ষীটারী (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা), কাগজের মানুষেরা (প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা), মোনাজাত উদ্দিন রচনাসমগ্র (দুই খণ্ডে)(প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১০, সম্পাদনা: ড. আতিউর রহমান, ড. সৌমিত্র শেখর, নাসিমুজ্জামান পান্না, দীনেশ দাস, ম. হাসান, প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা)।

মোনাজাত উদ্দিনের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ২৩২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৭
এমপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।