ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

গবেষণায় উদ্ভাসিত রোহিঙ্গা নিধনের মর্মান্তিক ইতিহাস

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৮
গবেষণায় উদ্ভাসিত রোহিঙ্গা নিধনের মর্মান্তিক ইতিহাস ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের লেখা গ্রন্থ

সাম্প্রতিক সময়ে পৈশাচিক হিংস্রতা ও পাশবিক নিষ্ঠুরতায় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চলছে, তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে হিটলারের জার্মানিতে।

হিটলার চেয়েছিল সমগ্র ইউরোপ থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে। আর মিয়ানমার জান্তা চায় রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার থেকে নির্মূল করতে; উভয় ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য জাতিগত নিধন।

গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে যে অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা শুরু হয়, তাতে প্রায় ৭ লক্ষ শরণার্থী ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে চলে এসেছে। অতীতেও নিপীড়িত হয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন দাবি করেছেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধন অনেক আগে থেকেই চলছে। রোহিঙ্গারা সেদেশে বহিরাগত নয়, বরং মিয়ানমারেরই বাসিন্দা। তিনি দেখিয়েছেন, রাখাইন (আগে যার নাম  ছিল আরাকান) রাজ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অবস্থান ত্রয়োদশ/চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই। তাদের একটা স্বাধীন রাজ্য ছিল যা আরাকান বা রোসং/রোহং নামে পরিচিত ছিল। ভূ-নৈকট্যের কারণে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সঙ্গে একটা নিবিড় সংযোগ তাদের সবসময় ছিল; সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি ঈর্ষণীয় ঐতিহ্যও গড়ে উঠেছিল সেখানে। মহাকবি আলাওল, মালিক জায়সী ও দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখেরা যার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

‘লুণ্ঠিত আরাকানে রোহিঙ্গা জাতির আর্তনাদ’ শীর্ষক বিপুলায়তন গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯৬২ সালে বার্মার এক আইনে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। তারা সকল সভ্য নাগরিক অধিকার তথা মৌলিক মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়। তখন থেকেই তাদের দুর্ভাগ্য ও নির্যাতনের শুরু। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গমস্থলে সমুদ্রতীরবর্তী হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ আরাকান। ঐতিহাসিকভাবে রাজ্যটি ছিল বরাবরই স্বাধীন ও অতিশয়  সমৃদ্ধিশালী। ম্রোহং বা রোসাঙ্গ শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এই রাজ্যের রাজধানী। চট্টগ্রাম, পেগু ও আরাকান এই তিন জনপদের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে এই রাজ্যের পরিধি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে‌‌‌ই ইয়েমেনীয় ও ব্যাবিলনীয় অঞ্চলের আরবগণ (অমুসলিম আমলের) সমুদ্রবিদ্যায় পারদর্শিতার কারণে চীনা ও ভারতীয় অঞ্চলের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকারী ছিল।

ঐতিহাসিক ভাষ্যমতে, অষ্টম শতকে আরব বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে এবং ফকির-দরবেশরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম-আরাকানে আগমন করেন। ৭৮৮ থেকে ৮১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মহত ইঙ্গ চন্দ্র নামে একজন রাজা আরাকান রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময়ে একদল আরব বণিক পালের জাহাজে করে  ‘রামরী দ্বীপে’র নিকটে পৌঁছলে ঘটনাক্রমে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজগুলো ভেঙে যায়। তখন বণিকদল বিপন্ন হয়ে তীরে অবতরণ করেন। রাজার আদেশে তারা আরাকান রাজ্যে বাস করার অধিকার পান। এই বণিকেরা স্থানীয় নারীদের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তান-সন্ততিরাই হলো আরাকান রাজ্যের ভূমিপুত্র বা আদি জনগোষ্ঠি। আধুনিক কালে যারা মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি নামে পরিচিত।

১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে অনরথ নামক এক রাজা এ অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করে একটি একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং পগান প্রদেশে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা অনরথের রাজত্বকালকে স্বর্ণকাল বলা চলে। বৌদ্ধধর্মে অতিমাত্রায় অনুরক্ত এই রাজা শহরজুড়ে অনেক মন্দির ও প্যাগোডা নির্মাণ করেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে এই রাজ্যের একদিকে  ‘শান’ ও আরেকদিক থেকে  ‘মোঙ্গল’ জাতি দখল করে এবং একে ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে দেশটি চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলো হলো উচ্চ বার্মা, নিম্ন বার্মা, শান প্রদেশ ও আরাকান প্রদেশ।
১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে এক অবাঞ্ছিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আভার রাজা মেঙ্ৎ শোঅই (মিন কৌং) আরাকান আক্রমণ করেন। তিনি নরমিখলাকে (১৪০৪-১৪৩৪) পরাজিত করে আরাকান দখল করেন। নরমিখলা বাংলার (গৌড়ের) সুলতানের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে তার রাজ্য উদ্ধারে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। নানান ঘটনাপ্রবাহের কারণে আশ্রয়ের দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৪-১৪৩১ খ্রি.) সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে গৌড়ের বিশাল সেনাবাহিনীসহ নরমিখলাকে আরাকান রাজ্যে প্রেরণ করে তা দখল করে নেন। যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে  ‘সান্ধিকান’ নামে একটি মসজিদও প্রতিষ্ঠিত করেন।

গৌড়ের সেনাপতি ওয়ালী খান আরাকানের রাজা নরমিখলার দরবারে কাজী নিযুক্ত হন এবং তখন আরাকানে ফার্সি ভাষা চালু হয়। মুসলিম জনপদ আরাকানের রাজদরবারে এই প্রথম আনুষ্ঠানিক ও সক্রিয়ভাবে মুসলিম রীতি প্রবিষ্ট করা হয়। সিংহাসন উদ্ধার করার পর নরমিখলা চার বছর (১৪৩০-১৪৩৪ খ্রি.) রাজত্ব করেন। এ সময় থেকে আরাকানরাজ নরমিখলা গৌড়ের মুসলমান সুলতানদের মত তাঁদের মুদ্রার এক পিঠে ফার্সি অক্ষরে ইসলামী  ‘কলেমা’ ও মুসলমানী নাম লেখার রীতি চালু করেন।

গৌড়ের মুসলমান সুলতানদের প্রভাবেই নরমিখলা তাঁর রাজ্যে এই রীতি চালু করেছিলেন, যেহেতু গৌড়ে তিনি মুসলমান সুলতানের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে ছিলেন দীর্ঘ ২৪ বছর। নরমিখলার পরবর্তী রাজারাও মুদ্রার এক পিঠে ফার্সি অক্ষরে ইসলামী  ‘কলেমা’ ও অপর পিঠে তাঁর বৌদ্ধ-নাম ব্যবহার করতেন। এর সঙ্গে একটি করে মুসলমানী নামও ব্যবহার করতেন। ১৪৩০ থেকে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামী নাম, উপাধি গ্রহণ করেছিলেন আরাকানের ১৭ জন রাজা।  

শুধু আরাকানের রাজারাই নন, রাজ-অমাত্যবর্গ, সৈন্যবিভাগের প্রধান থেকে শুরু করে প্রত্যেক বিভাগের প্রধান কর্মচারীরাও মুসলমানী নাম গ্রহণ করেছিলেন। নানা বর্ণে ও নানা রঙে উন্নত ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব আরাকানের অনুন্নত বৌদ্ধসংস্কৃতির ধারক ও বাহক শাসকগোষ্ঠী আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। আরাকান কেবল রাজ দরবারই নয়, সমগ্র আরাকান ও চট্টগ্রামব্যাপী তখন ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাবে ভরপুর হয়ে যায়। যাঁরা এই বৌদ্ধ রাজাদের অমাত্য, মহাজন, পাত্র-মিত্র, সেনাধ্যক্ষ ছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান।

আরাকানে মুসলিম শাসন প্রাধান্য পাবার ফলে ম্বো, মিঙ্গান, কালাডন, মায়ু, নাফ প্রভৃতি নদীর উভয় তীরে মুসলিম জনপদ গড়ে ওঠে এবং মুসলিম আধিপত্য ও উপনিবেশ স্থাপিত হয়। ১৬২২ থেকে ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ মাত্র ছেষট্টি বছরের মধ্যে আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যের যে সর্বতোমুখী বিকাশ সাধিত হয়, তার তুলনা বাঙ্গালা ভাষার আপন গৃহেও মেলে না। প্রকৃতপক্ষে আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এতো যে বৈভব-ঐশ্বর্য, বিষয়-বৈচিত্র্যের এতো যে বিকাশ ঘটেছিল, তা মূলত মুসলমানদেরই অবদানের ফল।

জামাল উদ্দিনের দাবি, কোনো সংশয় ছাড়াই বলা যায়, ৭৮৮ সাল থেকে ১৪৩০ সাল ও পরবর্তীকালে মুসলিম নাম ধারণকারী ১৭ জন আরাকান রাজার শাসনামলে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক মুসলমান, ধর্মান্তরিত মুসলমান ও তাদের পরবর্তী বংশধরেরাই হলো  ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’। বংশপরম্পরায় তারা হাজার বছর ধরেই আরাকানে বসবাসরত।

গবেষক জামাল উদ্দিনরোহিঙ্গা জাতির  অনেক খ্যাতিমান পুরুষ আরাকান রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর প্রধান ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একজন মুসলমান আরাকানের রাজ সিংহাসনে আরোহন পর্যন্ত করেছিলেন।
উপরোক্ত তথ্যের আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, রোহিঙ্গারা কখনো রাখাইনে বা আরাকানে অনুপ্রবেশ করেনি, তারা আরাকান ভূমিরই অকৃত্রিম সন্তান। বরং তাদের রাজ্যটি যারা কেড়ে নিয়েছে, তারাই আজ জোরপূর্বক রোহিঙ্গা জাতিকে নিধন করে চলেছে।
জানা যায়, ১৭৮৪ সালে স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করে বার্মার রাজা বোধপায়া। ঐ সময় আরাকানরাজ ‘থামাদা’ সপরিবারে বর্মী বাহিনীর হাতে নিহত হন। বর্মী সৈন্যরা বন্দি ২০ হাজার আরাকানি সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একই সাথে হত্যা করে দু’লাখ নারী-পুরুষকে। আরো প্রায় দুই লক্ষ আরাকানীকে দাস হিসেবে বার্মায় প্রেরণ করে। বন্দী দাসদের সিংহভাগই ছিল রোহিঙ্গা মুসলমান। যারা এইসব হত্যাযজ্ঞ থেকে অব্যাহতি লাভের আশায় জঙ্গলে পালিয়েছিল তাদেরও অনেককে বর্মী সৈন্যদের হাতে, নয়তো বাঘের মুখে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তখন বর্মীরাজের এরূপ চণ্ডনীতির ফলে অসংখ্য আরাকানী মগ, চাকমা, রোহিঙ্গাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে মৃত্যুভয়ে তারা আর স্বদেশে ফিরে যায়নি। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারেই তারা স্থায়ী হয়ে যায়। নৃ-তাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একথা প্রমাণ করে। ফলে তখন থেকেই দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে লোকসংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। বোধপায়া আরাকানকে বার্মার সাথে একীভূত করে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করে। তখন থেকেই আরাকানীদের দুর্ভোগ আর গৃহত্যাগের সূচনা ঘটে। ক্রমান্বয়ে এটা চলতে চলতে বর্তমান সময়ে এসে উপনীত হয়েছে।

ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন মনে করেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত বলার কোনও সুযোগ নেই। বাংলার সঙ্গে সংযোগ থাকলেও এরা বাঙালি নয়, মিয়ানমারেরই একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। রোহিঙ্গাদের প্রতি জাতিগত নিধনও নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরেই তা চালিয়ে আসছে মিয়ানমারের প্রধান জাতিগোষ্ঠীর লোকজন। ঐতিহাসিক গভীরতার আলোকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক উভয় পর্যায়ে সমস্যাটির সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত বলেই মত দেন এই গবেষক।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৮
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।