ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

নতুন প্রজন্মের আইডেন্টিটি রক্ষায় কতটুকু করতে পারছি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮
নতুন প্রজন্মের আইডেন্টিটি রক্ষায় কতটুকু করতে পারছি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্ম

দেখতে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রথম প্রজন্ম হিসেবে আমাদের অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এদেশের অভিবাসন ভিসা পদ্ধতি কিংবা স্টুডেন্ট ভিসা বা অন্যান্য উপায়ে প্রবাসী হয়ে আমরা যারা একদিন গ্রিন কার্ডধারী হয়ে বসবাস শুরু করি, তাদের অনেকের পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছে নতুন প্রজন্ম বা কারো কারো ভাষায় দ্বিতীয় প্রজন্ম। দিনে দিনে সময় যতই এগুচ্ছে, ততই এই নতুন প্রজন্মের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে এবং এরা পাশ্চাত্যের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশের মধ্যে থেকে বেড়েও উঠছে আপন গতিতে।

আর এইভাবে চলতে থাকলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের এই নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে এদেশের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেদেরকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে, খাঁটি আমেরিকান হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিসে, ব্যবসা-বানিজ্যে, রাজনীতিতে এমনকি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসীন হতে সক্ষম হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই সুন্দর স্বপ্ন ইতোমধ্যেই কোথাও কোথাও বাস্তবায়ন হতেও শুরু করেছে।

নতুন প্রজন্মবস্তুত জন্মভুমি বাংলাদেশ ছেড়ে যোজন-যোজন দুরের এই প্রবাস জীবনে এসে দ্বিতীয় নিবাস গড়ে তোলার পর  যখনথেকে অনুভব করতে শুরু করেছি যে,এই আমেরিকাই হবে আমাদের স্থায়ী নিবাস, আর তখন থেকে আমাদের সন্তানদের কাছ থেকেও আমরা তাদের মসৃণ পথচলার মাঝে একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি এবং আমরা সেই প্রত্যাশিত স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষাতেই দিন গুনছি প্রতিটি ক্ষণ।  

তাই মেঘে মেঘে অনেক বেলা পার হয়ে যাওয়ার পর আজকের দিনে আমার প্রশ্ন, বিশ্বের এই সেরা আধুনিক দেশটিতে বেড়ে ওঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্যে সত্যিকার অর্থে আমরা কতটুকু করতে পারছি কিংবা আদৌ কি কিছু করতে পারছি? আসলে আমি এদেশে জন্মগ্রহণকারী আমাদের আমেরিকান সন্তানদের আমেরিকান ড্রিমের কথা বলতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি একাত্তুরে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে যে দেশটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেই দেশেরউত্তরাধিকার হিসেবে প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মেরআত্ম-পরিচয় বা আইডেন্টিটির কথা, আমাদের পূর্ব-পুরুষের শেকড়ের কথা।  

আমার প্রশ্ন, আমরা কি সেই আইডেন্টিটি বা আত্ম-পরিচয়কে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মাঝে সত্যিকার অর্থেই সম্পৃক্ত করাতে বা ধারণ করাতে পারছি? নাকি আমরা কামনা করছি এটাই যে, সময়ের গহ্বরে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য বা সাংস্কৃতিক গৌরব গাঁথার কথা একদিন এইসব দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে একটি অপরিচিত অদ্ভুত বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পাবে? নাকি তাদের শেকড় থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে একদিন এক নামগোত্রহীন আমেরিকান হিসেবে মূলধারায় নিগৃহীত হতে থাকবে?

আসলে এই বিষয়টিকে আমরা অভিভাবকরা কোনভাবেই আমলে নিচ্ছি না বা পরোয়া করছি না আজকাল। তবে একথা সত্য যে, আমরা এখনও মনে-প্রাণে বাংলাদেশি হিসেবেই নিজেদেরকে ধারণ করতে চাই এবং সেটি সীমাবদ্ধ থাকছে কেবল আমাদের প্রথম প্রজন্মের মধ্যেই। আর একারণে আমরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গৌরব-গাঁথা বা বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় চর্চা-আদর্শকে বুকে ধারণ করে নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মসূচিতে নিজেরাই অংশ গ্রহণ করে চলেছি। স্বদেশের রাজনীতি চর্চাতেও আমরা কারো চাইতে কম নই। স্বদেশের রাজনীতি চর্চার মতো এখানকার গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কর্মসূচী, সাংগঠনিক তৎপরতা এমনকি দলের মধ্যকার নানা বিভেদ, কোন্দল, পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ, কমিটি গঠনের অস্থিরতা-এসব দেখলে মনেই হবে না যে আমরা স্বদেশ থেকে সাত-সমুদ্দর তেরো নদীর পারের একটি ভিন্ন দেশে বাস করছি।

শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্যান্য অভিবাসী জাতি বা প্রবাসীদের মতো আমরাও বাংলাদেশকে, বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে গতিশীল রাখতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলছি। স্বদেশের চেতনায় মহান একুশ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বৈশাখী মেলা, বনভোজন, পুনর্মিলনী ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ থাকছেনা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়েও গড়ে উঠছে নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক বা ইস্যু ভিত্তিক সংগঠন। এরাও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে প্রাণচঞ্চল রাখার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট। অথচ এর সবই প্রতিফলিত হচ্ছে শুধুআমাদের প্রথম প্রজন্মের মধ্যেই।

আর একারণে খুব লজ্জা ও দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে,আমাদের নতুন প্রজন্মের উৎসাহ, আগ্রহ বা স্বতঃস্ফূর্ততা কোনটিই দেখা যাচ্ছেনা আমাদেরই নিজেদের অনাগ্রহ বা গাফিলতির জন্য।  

তবে যে একবারেই নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ নেই, একথা অস্বীকার করবো না। কোনো কোনো পরিবারে ছেলে- মেয়েরা আমাদের সংস্কৃতিকে, মাতৃভাষা বাংলাকে নিষ্ঠার সাথে ধারণ করে অভাবনীয় সাফল্যও এনেছে। তবে এই হার খুবই নগণ্য।  

এই যেমন, আমাদের এই আটলান্টা শহরেই ২০০২ সালে মনজিমা নামের ছয় বছরের এদেশে জন্ম নেয়া যে ছোট্র মেয়েটি দাদুর কাছে বসে বসে একদিন বাংলা শিখে ফেলেছিল, সেই মেয়েটি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে এসেও বাংলা ভুলেনি। ও’ এখন বাংলাদেশি কমিউনিটির অনুষ্ঠানে সাবলীল বাংলায় উপস্থাপনা করতে পারে, বাংলায় লিখতে পারে, এর চাইতে সুখের খবর আর কি হতে পারে?

আবার এদেশে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোররা আজ বাংলাদেশের শিশুদের সুখ-দুঃখের নানা কাহিনী শুনেও আনন্দে যেমন উচ্ছ্বসিত হয়, তেমনি ব্যথিতও হয়। তাই উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে ‘শিশুদের জন্যে শিশুরা’ এই শ্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে সম্প্রতি ভিন্নধারার তহবিলে গঠনের একটি কনসার্টেও একযোগে পারফর্ম করেছে আমাদের প্রায় পঁচাত্তর জন শিশুকিশোর। লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশি দুখী, অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ানো। এটাও কম আনন্দের নয়।

নতুন প্রজন্মতবে এর পরও কথা থেকেই যায়, ওদের সাথে আমাদের কোনো যোগসূত্রতা তৈরি হচ্ছেনা শেকড়কে শেখাবার জন্যে। ফলে কখনো কখনো তাদেরকে আমরা নানা বাংলাদেশি অনুষ্ঠানেঅংশগ্রহণ করাতে বাধ্য করছি বলে নতুন প্রজন্ম তাদের অভিব্যক্তিতে আমাকে জানিয়েছে। কোমলমতি শিশু-কিশোর কী উপলক্ষে বা কিসের উদ্দেশে এসব অনুষ্ঠানেপারফর্ম করছে, সেটা তাদের কাছে অস্পষ্ট। অর্থাৎ আমরা অভিভাবকরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে মঞ্চে পাঠিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু তাদেরকে আমার স্বদেশের সংস্কৃতির ঐ পারফর্মেন্সের বিষয়বস্তুটি নিয়ে বিস্তারিত কোনো কিছু অবহিত করাচ্ছি না বা সে সম্পর্কে শিক্ষা দিতে ভুলে যাচ্ছি।  

আর তাই আজ দেখতে পাচ্ছি, একদিকে স্বদেশের প্রতি এই আকুতিময় ভালোবাসার বহির্প্রকাশ আমরানিজেরা প্রকাশ করছি বা চর্চা করছি, ঠিক তার উল্টো হারে ঘটে চলেছে ভিন্ন এক আশঙ্কার চিত্র আমাদের উত্তরসূরিদের মাঝে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে এর প্রতি তীব্র অনাগ্রহ বা এড়িয়ে চলার এক নৈরাশ্যজনক মানসিকতা। তাই মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয় এই ভেবে যে, নতুন প্রজন্মের আইডেন্টিটি বা আত্ম-পরিচয় রক্ষায় আগামীদিনে এরা কঠিন কোন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে কিনা।

আশঙ্কাটি কেনই বা হবে না? এব্যাপারে কয়েকটি ছোটখাটো উদাহরণ দিই। এই যেমন ধরা যাক, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের একটি অনুষ্ঠানে গেলাম, সেখানে আলোচনা শুনছি একাত্তুরের প্রেক্ষাপটে। বাঙালি জাতি কীভাবে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে শহীদের রক্ত আর মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দিল, এসব সারগর্ভ আলোচনা শোনার পাশাপাশি আমি নিজেও আলোচনায় অংশ নিচ্ছি। কখনো হয়তো কোনো গুণী শিল্পীর দরাজ কণ্ঠের গানও শুনছি। অথচ এরই ফাঁকে আমার পাশের চেয়ারে বসে থাকা সন্তানটি কখন যে আসন ছেড়ে বাইরে গিয়ে একই বয়সী অন্য বন্ধুদের সাথে তাদের ভাষায়, তাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে ভাব বিনিময় করছে, আড্ডায় মেতে উঠেছে কিংবা হৈ চৈ, ছুটাছুটি করছে, আমি কিন্তু টেরও পাচ্ছি না।

এটি কেন হচ্ছে? আমি অনুষ্ঠানে আসার আগে কখনো আমার সন্তানকে সেই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বলার বা ব্যাখা করার প্রয়োজন মনে করছি না, সেটি কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, নাকি একুশে ফেব্রুয়ারির শ্রদ্ধাঞ্জলি, নাকি নববর্ষের কোনো বৈশাখী মেলা-এসব কোনো ধারনাই আমার সন্তানটির ভেতরে নেই। মুলত আমার নিজেরই কোনো আগ্রহ নেই সন্তানদের কাছে শেয়ার করার জন্যে।  

প্রবাসে আমরা যে কাজটি সব চাইতে খারাপ করছি, সেটি হচ্ছে, বাড়িতে ছেলেমেয়েদের সাথে অনর্গল বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছি। ছেলেমেয়েরা এমনিতেই স্কুলে বা বাইরে তাদের স্বাভাবিক নিয়মে এদেশের ভাষা ইংরেজিতেই কথা বলে থাকে। সেই ক্ষেত্রে কোথায় আমি ছেলে-মেয়েদেরকে বাড়িতে বাংলা ভাষায় কথা বলার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে দেব, সেটি না করে আমি নিজেই ইংরেজি ভাষার পাণ্ডিত্য দেখাচ্ছি ওদের সাথে। এর চাইতে আর কি লজ্জা থাকতে পারে আমাদের প্রবাস জীবনে। অথচ আমি হলফ করে বলতে পারি, ঘরে ছেলে-মেয়েদের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বললে ওদের মধ্যে কোন না কোনভাবে বাংলার প্রতি  মমত্ব বোধটুকু তৈরি করানো সম্ভব।

আরও একটা ঘটনার কথা বলি। কয়েক বছর আগে আমার বন্ধুর দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া এক কন্যার সাথে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছিলাম গাড়ি চালানোর সময়। একপর্যায়ে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কি হয়েছিল জানতে চাইলে মেয়েটি একটু ভেবে-চিন্তে খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্কারভাবে বলছিল যে, সেসময় স্বাধীনতার জন্যে বাঙালিরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল এবং কিছু মানুষ পাকিস্তানিদের গুলিতে তখন মারা গিয়েছিলো।

সেদিন আমি এধরনের উত্তর শুনে হতবাক হয়েছিলাম। তার সাথে আর কোনো কথা বলার সাহস পাইনি। পরে ভেবে দেখেছি যে, এখানে হতবাক হবার তো কিছুই ছিলনা! কেননা আমরা অভিভাবকরা জীবন জীবিকা ও ডলারের পেছনে এতটাই ব্যস্ত সময় কাটাই যে, সন্তানদের কাছে পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলার বা গল্প করার বিন্দু মাত্র সময়ও বের করতে পারিনা। কাজেই ওর কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আর কি আশা করতে পারি? অথচ আমরা কোনভাবে যদি ওদের ভেতরে নিজেদের আইডেন্টিটি বা শেকড়কে একটু একটু করে সম্পৃক্ত করাতে পারি, তবে ওরা নিজেরাই অন লাইনে, গুগলে বা নানা মাধ্যমে প্রবেশ করে ওদের পূর্ব-পুরুষের সব কিছুই আত্মস্থ করে নিতে পারবে। এই বিশ্বাসটিও আমাদের রাখতে হবে।    

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছি যে, আমাদের কমিউনিটির সংগঠনগুলোর নানা তৎপরতা নিয়েও নতুন প্রজন্মের মধ্যে একধরনের বিরূপ মানসিকতা আজকাল লক্ষ করা গেছে। মুলত যেসমস্ত ছেলেমেয়েরা বর্তমানে স্কুল পেরিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে, তাদের মধ্যেই এধরনের মানসিকতা বেশি। এদের মতে, বাবা-মাদেরকে খুশি করার জন্যেই তারা বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে থাকে। তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশি কমিউনিটির বেশির ভাগ আংকেল সংগঠন করতে গিয়ে পরনিন্দা করছেন। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের কাছে নানা কুৎসা রটনা এবং এক দলের সাথে আরেক দলের হিংসাত্মক আচরণ তাদের কাছে একটি অস্বস্তিকর ও লজ্জার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে এসব কর্মসূচী থেকে তারা দূরে থাকতেই পছন্দ করে।  

নতুন প্রজন্মএই হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মের হালচাল। কিন্তু এই চিত্রটি তো ফুটে ওঠার কথা ছিল না আমাদের নতুন প্রজন্মের চিন্তা চেতনায়! ওরা জন্মগত সুত্রে এবং অফিসিয়ালী আমেরিকান হলেও ওদের তো বেড়ে উঠার কথা পূর্ব-পুরুষের চেতনায় বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক হিসেবে! 

আমার ধারনা, আমরা নিজেরা যতই দেশপ্রেম নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি বা সাংগঠনিক তৎপরতায় সক্রিয় থাকি না কেন, একইসাথে নতুন প্রজন্মকেও সেই চেতনাবোধে উজ্জীবিত করতে না পারলে প্রবাসে বাঙালির শেকড় ঠিক ঠিকই একদিন মুছে যেতে বাধ্য হবে এবং আমাদের সন্তানেরা আইডেন্টিটি সংকটের মুখোমুখি হয়ে অনিশ্চয়তার গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকবে।

অথচ এই প্রবাসে আমাদের আশেপাশের অন্যান্য অভিবাসী জাতির দিকে তাকাই না কেন? যুগ যুগ ধরে এইসব ভিনদেশি অভিবাসী গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভাষাকে তাদের পরিবারেও নতুন প্রজন্মের মাঝে লালন করে যাচ্ছে। ধরুন না স্প্যানিশ, আইরিশ, আফ্রিকান, জার্মান কিংবা ইহুদী জাতির অভিবাসীদের কথাই ! এরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাস করেও নিজ নিজ সংস্কৃতি ও ভাষাকে সন্তানদেরকে শিখিয়ে আইডেন্টিটি সংকট থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে চলেছে। আর আমরা নির্বোধ বাংলাদেশি অভিবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে পরেরটাকেই মূলধন করে গর্ববোধ করছি।  

একটি কথা না বলে পারছিনা যে, আমরা অভিভাবকরা নতুন প্রজন্মকেআমাদের শেকড়ের কাছাকাছি নিতে না পারলেও আদর্শ মুসলিম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেলেঞ্জে সফল হতে চলেছে প্রবাসের মসজিদগুলো। মনে পড়ে, এই কয়েকবছর আগেও আটলান্টায় ডাউন টাউনের আল ফারুক মসজিদ ছাড়া জুম্মা নামাজ পড়ার কোনো জায়গা ছিলনা। আর আজকের দিনে আটলান্টায় পঞ্চাশটিরও বেশি মসজিদে নিয়মিত নামাজ, রোজার সময়ে তারাবি এবং সেইসাথে ধর্মীয় চর্চা হচ্ছে। আমাদের সন্তানেরা আজ সেখান থেকে ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এই পাশ্চাত্যের দেশে জন্মগ্রহণ করেও আদর্শ মুসলমান হিসেবে নিজেদের ধর্মীয় আইডেন্টিটিকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর এর ভেতর দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম এই পাশ্চাত্যের অতি আধুনিকতার নামে উগ্রতার ডামাডোল থেকে নিজেদেরকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ্ জীবন যাপনে অভ্যস্থ হতে পারছে।  

সবশেষে এটি বলবো যে, মাল্টি কালচারের এই আধুনিক সভ্য দেশে এইভাবে সকল ধর্মের এবং সকল সাংস্কৃতিক চেতনার নাগরিকদের নিজ নিজ আইডেন্টিটিকে ধরে রাখার যে পূর্ণমাত্রায় স্বাধীনতা রয়েছে, একথা কারো অজানা নয়। তাহলে আমাদের সন্তানদের আইডেন্টিটি রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা কেন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছিনা? আসুন না, এখনও সময় আছে, আমরা সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে একবার চেষ্টা করে দেখি।  

রুমী কবির: লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, আটলান্টা, জর্জিয়া।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩২ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮
এসআইএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।