ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মামার বাড়ির আবদার!

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১১
মামার বাড়ির আবদার!

রোডমার্চ করতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া যে গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছেন তা শুনে ভিরমি খাওয়ার দশা হয়েছে। কতো কথা যে তিনি বলছেন তার ইয়ত্তা নেই।

ক্ষমতার জন্য এভাবে মরিয়া হয়ে উঠলে কি চলে!

সস্তা গতানুগতিক সাদামাটা কথাবার্তার মাজেজা তো এখন গ্রামের অশিক্ষিত সহজ-সরল মফিজ মিয়ারও বুঝতে অসুবিধে হয় না। ডিজিটাল যুগের সাথে সাথে দেশ যেখানে ডিজিটাল হতে শুরু করেছে সেখানে আমাদের বিরোধী দলীয় নেতার এহেন ব্যাকডেটেড রাজনৈতিক কথন বড্ড বেমানান। বিরোধী দলে থেকে ভারতবিরোধী কথা (সরকারে থাকাকালীন ভারতপ্রীতি যেখানে উপচে পড়ে), সরকারের দুর্নীতি, নিজেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন একেবারে সাধু-সন্ত, আল্লাহর অশেষ রহমতে আবার ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলে সকল সমস্যার মিরাকল সমাধান ইত্যাদি কথাবার্তা বলে বক্তৃতার মঞ্চে সাময়িক ঝড় তোলা যায় বটে, কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে এসব সস্তা ডায়ালগ জনগণের কাছে অনেকটা অচল টাকার মতোই বলে মনে হয়।

ধর্মের দোহাই বা সাম্প্রদায়িকতা নামের ট্রাম কার্ডের মাধ্যমে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে বাগিয়ে নেওয়ার মতো সময় অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বেশ ক’বছর আগে গফরগাঁওয়ের এক বন্ধু বিএনপির নির্বাচনী ক্যাম্পিংয়ের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ওইখানকার বিএনপিপন্থী তরুণ প্রজন্ম দুটো ‘মূর্তি’ সাথে নিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের ঘরে ঘরে ভোট চাইতে যেত। ‘মূর্তি’ দুটোর একটি মসজিদ, অন্যটি মন্দির। তারা এসব দেখিয়ে সাধারণ জনগণকে কোথায় ভোট দেবেন বলে জানতে চাইত। স্বভাবতই সহজ-সরল ধর্মভীরু মানুষ ওইসব ধূর্তদের ধোঁকাবাজিতে পরাস্ত হয়ে মসজিদের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে দিতেন। কুটিল হাসিতে আত্মহারা হয়ে তারা বোঝাতো ওই ‘মসজিদ’ই হচ্ছে ধানের শীষের প্রার্থী। সুতরাং বেহেশতের চাবি পেতে হলে তাকেই ভোটটা দিতে হবে। বিগত দশকগুলোতে এভাবেই তারা ধর্মকে পুঁজি করে হাসিল করে নিয়েছেন রাজনৈতিক স্বার্থ।

প্রয়াত মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকে একটি সংলাপ আছে: ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়’ । প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা ও মন-মানসিকতার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটেছে। আমাদের সমাজেও এর প্রভাব পড়েছে। মানুষ এখন আর আগের মতো ধর্মান্ধ নন। ধর্মের ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তাদের টলিয়ে আর ফায়দা লোটা যায় না। মানুষ এখন অনেক সচেতন। কী আওয়ামী লীগ বা কী বিএনপি এসব তারা বুঝতে চান না। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিতে শিখছে বাংলার মানুষ। সুতরাং গলাবাজিতে ভেল্কিবাজির বেলা একেবারেই শেষ।

ফিরে যাই রোডমার্চের কথায়। বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে বিএনপি ও জামায়াতের অনেক নেতা অনেক মন্তব্যই করেছেন। এত কিছু আলোকপাত করতে গেলে লম্বা ফিরিস্তি দিতে হয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার কয়েকটি গরম কথা এ লেখায় না এনে পারছি না। তিনি ভৈরবের পথসভায় বলেন, আওয়ামী লীগ আল্লাহ নয়, মা দুর্গাকে বিশ্বাস করে। নরসিংদীর ইটাখোলায় বলেছেন, `দেবদেবীতে বিশ্বাসী সরকার আল্লাহর ওপর আস্থা হারিয়ে পূজা-পার্বণ করতে শুরু করে দিয়েছে। ` ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঙ্গালপাড়ায় বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, `ভালো লোক আওয়ামী লীগ করে না। ` আবার সিলেটে বিশাল জনসভায় বলেছেন, `সরকারের লোকেরা হিন্দুদের জায়গাজমি এমনকি মন্দির পর্যন্ত দখল করছে। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় যায় তখনই হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে। ‘আওয়ামী লীগে থাকলে শুধু নির্যাতিতই হবেন, কিছুই পাবেন না’ বলেও তিনি বিএনপিতে যোগদানের জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছেন।

অবশ্য আপসহীন খেতাবে ভূষিত এ নেত্রীর বক্তব্যের ধরণ এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিছুদিন আগেও যিনি বলেছেন শুধু মানুষের মুক্তির জন্যই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আবারও তিনি রাজনৈতিক প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছেন, তাহলে তিনি কী করে জীবনের এ সন্ধ্যাবেলায় অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন! এ কি শুধুই রাজনৈতিক মাঠ গরম করার জন্য, নাকি ক্ষমতার সেই রসদকে আবারও বগলবন্দি করার সুচতুর পাঁয়তারা। মানুষ কি এতটাই বোকার স্বর্গে বসবাস করে যে, তিনি যা বলবেন তাই জনগণ গিলে খাবে!

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী (তার দাবি অনুযায়ী) ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে মুখে যা আসছে তাই বলে বেড়াচ্ছেন খালেদা জিয়া। তিনি কি মনে করেন এসব বক্তব্যে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে? তাঁর বুদ্ধিমান উপদেষ্টারা কী বলেন?

‘আওয়ামী লীগ যারা করেন তারা সবাই আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে মা দুর্গার সাগরেদ হয়ে গেছেন’, ‘কোনো ভালো মানুষই আওয়ামী লীগ করেন না’ ---যিনি বলছেন সেই বিরোধীদলীয় নেতার শাসনামলে সংখ্যালঘুরা কতটা শান্তিতে ছিলেন বা ছিলেন না, তাঁর সরকার ভারতপ্রেমে কতটুকু হাবুডুবু খেত বা খেত না, দুর্নীতিতে চ্যম্পিয়ান হতে কার ক্রেডিট(?) কতো বেশি ইত্যাদি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে আরব্য উপন্যাসের মতো লম্বা কাহিনী সৃষ্টি করার কোনো ইচ্ছেই নেই। এসব বিষয় সবাই কমবেশি জানেন। শুধু এতটুকু বলতে চাই, তিনি ভৈরবে বলেছেন, `আওয়ামী লীগ আল্লাহ নয়, মা দুর্গাকে বিশ্বাস করে`, আবার সিলেটে বলেছেন সরকারের লোকেরা হিন্দুদের জায়গাজমি এমনকি মন্দির পর্যন্ত দখল করছে। আ’মীলীগ যখনই ক্ষমতায় যায় তখনই হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। ` তার এসব কথা বেসুরো হয়ে গেল না!

যারা আল্লাহকে ভুলে মা দুর্গায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন তারাই আবার কী করে মা দুর্গার লোকজনকে নির্যাতন করেন বা তাঁর পবিত্র ঘর দখল করার মতো দুঃসাহসী খেলায় মত্ত হয়ে । ওঠেন! এসব স্ববিরোধী বক্তব্যে কি তিনি হাস্যাস্পদ হচ্ছেন না?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এবার তিনি কোনো রাখঢাক রেখে কথা বলেননি। আওয়ামী লীগের আমলে মুজিববাহিনী কর্তৃক যে চল্লিশ হাজার(!)লোক নিহত হয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আগে তাদের বিচার তিনি দাবি করেছেন। সুন্দর কথা। যাদের মাধ্যমে লোকজন নির্যাতিত, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত হয়েছে তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে খোলা মাঠে না বলে সংসদে গিয়ে বলুন। জনমত গঠন করুন। তাছাড়া এসব হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করতে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আগে হওয়া উচিত। কেননা তারা তো আগে অপরাধ করেছে। সুতরাং সাজাটা তাদেরই আগে হওয়া উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার কেন যে এত মায়াকান্না তা বুঝে ওঠা বড়ই মুশকিল।

 বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরের একটি খবর দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। খবরে বলা হয়ছে, ‘জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে সরকার পরাভব মানতে বাধ্য হবে হবে হবে। আমি রাস্তায় নেমেছি। অত্যাচারী সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরবো না। ’ এও বলেছেন জনগণ ধাক্কা মেরে সরকারকে ফেলে দেবে। এসব মুখরোচক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ কথাবার্তার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নিজের ক্ষতি বৈ মঙ্গল করছেন বলে মনে হয় না। তিনি যেভাবে একটি নির্বাচিত সরকারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবার  বা পতনের কথা বলছেন তা শুনে মনে হচ্ছে, এসব কোনো রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক ভাষার কথা নয়, যেন মামার বাড়ির আবদার।      

বাংলাদেশ সময় ১১৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।