ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

অপ্রতিরোধ্য বাংলাভাষা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮
অপ্রতিরোধ্য বাংলাভাষা ভাষার ফেব্রুয়ারি আশার ফেব্রুয়ারি

আশাপ্রদ একটি খবরের সূত্রে জানা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা শেখার দরকার পড়ছে সেদেশের নাগরিকদের। ক্রমবর্ধমান বাংলাভাষী মানুষের কারণেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, মধ্যপ্রাচ্যের কোনও কোনও দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চল, এমনকি ইংল্যান্ড বা কানাডার কিছু এলাকার প্রধান ভাষা বাংলা। বাংলাভাষী মানুষ বিশ্বায়নের এ যুগে যেখানেই সমাজবদ্ধ হয়েছেন, সেখানেই মুখরিত হয়েছেন রক্ত আর আবেগ মথিত বাংলায়।

এভাবেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাভাষা।

লক্ষ্য করে এটাও দেখা গেছে, প্রবাসের মাটিতে বাংলাভাষার চর্চা কেবল বাঙালি নরগোষ্ঠীর মানুষ নন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাহচর্যে এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে পশ্চিমা বিশ্বের অথবা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষাভাষীর মানুষেরাও অতীতকাল থেকে করে চলেছেন। কলকাতা বা ঢাকার মাড়োয়ারির মুখে বাংলা শুনে কে বলবে যে, লোকটির মাতৃভাষা বাংলা নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে ঠিকই তারা সুচারুরূপে বাংলাকে রপ্ত করেছেন। বাণিজ্যিক কারণে বাংলা শেখার প্রবণতা বিদেশিদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে। বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে দক্ষিণ বা উত্তর ভারতের কর্মীরা দিব্যি বাংলা বলছেন; এজন্য যে, তাদের রোগীদের সিংহভাগই বাংলাদেশি। শহরের হোটেল, দোকান, বাজারেও টুকটাক বাংলাজানা লোকের দেখা পাওয়া গেছে।

আরব দেশে এতো বেশি বাংলাদেশি থাকেন যে, সেখানে ভাষাটি বেশ ছড়িয়ে গেছে। কাজের মতো বাংলা অনেককেই বলতে শুনেছি। ভারতীয় বা পাকিস্তানি ড্রাইভার বা দোকানিরা তো বেশ বাংলা বলতে পারে। বরং প্রমিত মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতি প্রবাসী বাংলা ভাষীদের আগ্রহ তুলনামূলক কম। তারা নিজেদের আঞ্চলিক কথ্যভাষাটিকেই চর্চা করতে পছন্দ করেন, যা তাদের নিজস্ব জেলার বাইরের মানুষের কাছে অনেক সময় বোধগম্যও হয় না।  

বিলেতে ও মধ্যপ্রাচ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা সমগ্র বাংলা ভাষীদের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যায় আক্রান্ত। একইভাবে অনেকেই পুরনো ধ্যান ধারণায় নিজেদের উত্তরাধিকারদের বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের উৎসাহ আন্তরিকভাবে পান না। বরং চেষ্টা করেন, আঞ্চলিক ভাষাটিকেই চর্চার অংশ হিসাবে ধরে রাখতে। একই ভাষার অঞ্চলে অঞ্চলে প্রভেদ থাকবেই এবং সেটাকে ঘুচিয়ে ফেলাও সম্ভব নয়। এই বৈচিত্র্য বজায় রেখেই প্রমিত বা মান্য ভাষাটিতে আয়ত্ত্ করারও যে দরকার আছে, এই বোধোদয় সৃষ্টি হওয়া খুবই জরুরি।

আশার কথা হলো, প্রবাসে বাংলাচর্চার আঞ্চলিক গণ্ডি এখন আর ততটুকু নেই। প্রবাসীদের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলাচর্চার বিদগ্ধ চেতনা তখন থেকেই সক্রিয় হতে শুরু করে যখন বিশ্বায়ন যুগের সভ্যতায় বিপুল ও বিশাল সংখ্যক বাংলাভাষী মানবগোষ্ঠী পৃথিবীর নানা প্রান্তে জড়ো হন এবং আধুনিক প্রযুক্তি সেই সভ্যতার সঙ্গে নিজের সংযুক্তিসাধন করে। এমনই বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসে নানা অঞ্চলের বাংলাভাষীর মধ্যে যোগসূত্র রচনার জন্য প্রমিত বাংলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। কারণ, মাতৃভাষা চর্চার প্রয়োজনে দরকার হয় এমন একটি সুষ্ঠু পারিপার্শ্বিকতা, যার প্রভাবে ভাষাচর্চার আবহ তৈরি হয়। একুশ শতকের প্রযুক্তি-সভ্যতা এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন সৃষ্টি করে দিয়েছে এমনই আবহ ও প্রয়োজনীয়তা।

পণ্ডিতরা জানিয়েছেন, পৃথিবীজুড়ে বিস্তীর্ণ বিশ্বায়ন ও হাইটেক সভ্যতা প্রসারিত হওয়ার পূর্বেও প্রবাসে মাতৃভাষা চর্চা ছিল। নানা পরিস্থিতির কারণেই তা চলছিল। যদিও প্রতিটি মাতৃভাষার জন্ম সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা ও সাংস্কৃতিক অঙনে, তথাপি সে ভাষার একটি গতিশীলতা আছে। মাতৃভূমির বাইরে যেখানেই কোনও ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হন, সেখানেই ভাষাটি একটি ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডত রচনা করতে সক্ষম হয়।

অতএব দেশে বা প্রবাসে, যেখানেই মানবশিশু জন্মগ্রহণ করুক না কেন, মাতৃভাষার মাধ্যমেই তার সেতুসংযোগ রচিত হয় নিজস্ব মানুষ, যথা পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সমাজসংস্কৃতি, ব্যবহারিক জীবনের বিবিধ রীতিনীতি ও ধর্মাচারের সঙ্গে। মানসিক গঠনেও সেই ভাষিক ঐতিহ্য আজীবন বজায় থাকে। এ কারণেই মানুষ প্রবাসজীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও মাতৃভাষা পরিত্যাগ করতে চায় না। চাপের পরেও ব্যক্তিগত জীবনে হলেও ভাষাটিকে ধরে রাখে।

অতীতে রাজভাষা গ্রহণ করার একটি বাধ্যবাধকতা ছিল বিজিত জাতির মানুষের জন্য। এভাবেই বাংলাদেশ অঞ্চল সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজিকে পেয়েছে। রাজশক্তির জোরে ভাষিক আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে বাণিজ্য উপলক্ষে দেশান্তরে গিয়ে বণিক সওদাগররাও করেছেন সেটা। আবার ধর্ম প্রচাকরাও করেছেন ধর্ম প্রচারের প্রয়োজন সূত্রে। এভাবেই এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু আদি ভাষাটি মুছে যায়নি।

অপ্রতিরোধ্য বাংলাভাষা অতীতে নানা ভাষার আগ্রাসনে মুছে যায়নি। বিশ্বায়নের তাণ্ডবেও বিপথগামী হবে না। বরং অতীতে যেমন সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, তুর্কি শব্দ গ্রহণ করেছে নিজের কাঠামোতে, বর্তমানেও বহু শব্দ গ্রহণ করবে। কিন্তু নিজের মৌলিক সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য মোটেও নষ্ট করবে না। এখানেই নিহিত রয়েছে বাংলাভাষার অপ্রতিরোধ্য শক্তিমত্তা ও আত্মনির্ভরশীলতা।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮
এমপি / জেএম
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।