ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রোজা লুক্সেমবার্গ: বিপ্লবী নারীর প্রতিকৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৩ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৮
রোজা লুক্সেমবার্গ: বিপ্লবী নারীর প্রতিকৃতি রোজা লুক্সেমবার্গের স্বাক্ষরসহ প্রতিকৃতি। ছবি-সংগৃহীত

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তিন দিন আগের তারিখটি ৫ মার্চ। ১৮৭১ সাল। পোলান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জামেস্কো শহর। এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেন রোজা লুক্সেমবার্গ।

১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি জার্মানির শ্রমিক শ্রেণির পক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ রোজা যখন লিখটেইনস্টাইন ব্রিজের নিচে ল্যান্ডওয়র ক্যানেলের জলে প্রাণত্যাগ করেন, তখন তাঁর মাত্র ৪৭ বছর বয়স। ততদিনে তিনি চিহ্নিত হয়েছেন ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম আইকনে।

সংগ্রামমুখরিত বৈপ্লবিকজীবন ছিল রোজা লুক্সেমবার্গের। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তৎকালের আত্মগোপনকারী-নিষিদ্ধ-বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলে যুক্ত হন তিনি। তিন বছরের মধ্যেই সবার নজর কাড়েন এবং পোলান্ড সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে ইউরোপীয় বিপ্লবীদের অস্থায়ী কেন্দ্র সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে এসে উপস্থিত হন। তখন তাঁর বয়স সবে ১৮। সেখানেই শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতা লেনিন, প্লেখানভ এবং নিজের জীবনসঙ্গী ও সহযোদ্ধা লিও জয়েসের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক হয় তাঁর।

রোজা লুক্সমবার্গের পরবর্তী কর্মক্ষেত্র জার্মানি, যেখানে তিনি ‘জার্মান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি’র হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯০৪ সালে জার্মান সম্রাটের বিরুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে তিনি জেলে যান। তিন মাসের কারাদণ্ডের সময়েও তিনি নিশ্চুপ থাকেননি। বন্দি সহযোদ্ধাদের নিয়ে নানা প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা করতে থাকেন। ১৯০৫ সালে যখন জারশাসিত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক আওয়াজ ওঠে, তখন রোজা জার্মানির শ্রমিক শ্রেণিকেও বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেন। রাশিয়া থেকে বহুদূরে অবস্থান করলেও তাঁর ছিল সুগভীর প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। যে কারণে তিনি মেনশেভিক সুবিধাবাদীদের বর্জন করে লেনিনের বলশেভিক পার্টিকে সমর্থন করেন। শুধু তাই নয়, জার্মান থেকে গোপনে পোলান্ডে গিয়ে তিনি আত্মগোপনে থেকে রুশ বিপ্লবকে সমর্থন ও সাহায্য করতে থাকেন। কিন্তু পোলিশ পুলিশের হাতে ধরা পরায় তাঁকে কিছুদিন আটকে রেখে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ১৯০৬ সালে।

রোজা লুক্সেমবার্গ কেবল মাঠের কর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যকার সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তিনি তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক তৎপরতার জন্য বিশিষ্ট হয়ে আছেন। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা বিতর্ক ও আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে তিনি তত্ত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করেন এবং নারীর ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন অধিকারের প্রশ্নেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।

‘ভোটাধিকার ও শ্রেণি সংগ্রাম’ নামে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে, যার প্রেরণায় বিশ্বে সর্বপ্রথম নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে। ফলে নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের পথে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। যুদ্ধ-বিরোধিতা এবং নাৎসী ও ফ্যাসিবাদের মতো ভয়ঙ্কর মতাদর্শের বিরুদ্ধেও রোজা লুক্সেমবার্গের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির হাতে। জীবন দিয়ে তিনি সংশোধনবাদ, যুদ্ধ এবং ফ্যাসি ও নাৎসীবাদের বিরোধিতা করে গেছেন।

বিশেষত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে রোজা লুক্সেমবার্গের মতো অগ্রণী নারী নেতৃত্ব খুব একটা দেখা যায়নি। বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্র ও তাত্ত্বিক ময়দানে তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন অগ্রসেনানী। ইউরোপীয় দেশগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার নিরিখে তিনি হলেন যথার্থ বিপ্লবীর প্রতিচ্ছবি। জীবনের চার দশকের কিছু বেশি আয়ুষ্কালের মধ্যেই মহৎ কর্ম ও সাহসী আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি বিপ্লবী নারীর প্রতিকৃতি হয়ে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন ইতিহাসের অম্লান পাতায়।

বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮

এমপি / জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।